মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: মুখ্যমন্ত্রী তাদের বাঁকা লেজ সোজা করার হাজারো চেষ্টা করুন, তার দলের সর্ষে ক্ষেতেই শয়ে শয়ে ভূত এখনো কিলবিল করছে। সেই সব অদ্ভুত, মোটা ভূত, কালো ভূত, সাদা ভূত, রোগা ভূতের হরেক রকম নাম ‘মাস্টারদা’ ,কাউন্সিলর, কাউন্সিলারের হাজবেন্ড, দলবদলু ভাগোড়া, চেয়ারম্যান বা স্রেফ ঠিকাদার। দুর্গাপুর নগর নিগমের নিয়ম-কানুন সব নাকি তাদের বুক পকেটে।
তাই বুক ফুলিয়ে ইটের ওপর ইট সাজিয়ে, খেয়াল মতো দেওয়াল তুলে, শহরের পাড়ায় পাড়ায় পাঁচ, ছয়, সাততলার সাতমহলা গড়ছেন, পকেট গরম করছেন, ফুটানি করে বেড়াচ্ছেন, এর তার বউদের টানাটানি করে ফূর্তি করছেন। আবার, ২১শে জুলাই ধর্মতলার ধম্মথানে মাথা ঠেকিয়ে সাধু সেজে ফিরে আসছেন নিজের নিজের জমিদারিতে। তাদের কেউ কেউ আবার ২১শে জুলাইয়ের হাজিরা খাতায় নামটুকু তুলতেও বেশ বিরক্ত। উনি নাকি পার্টির কেউনা! এই কি তবে শুদ্ধিকরণ ঘাসফুলের? এমন খোঁচা হজম করতে হচ্ছে দলের কোনো কোনো বড় মোড়লকে।
কিন্তু কি করছেন লেজ বাঁকা সে সব ভূতপ্রেতেরা? যা নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সম্মানহানি হচ্ছে? অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে তাদের মিশকালো মুখ লুকিয়ে, লেজ গুটিয়ে, গর্তে ঢুকে থাকা এই সব ভূতুড়ে লাটসাহেবেরা পুর ও নগরউন্নয়ন দপ্তরের নির্দেশ ও নিয়ম সংক্রান্ত আইন কানুন ধুলোয় মিশিয়ে তলার পর তলা ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে সমাজের ওপর তলায় রাজ করছেন বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে। এরকম অভিযোগ যাদের যাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি, তারাই আবার সময় সময় নগর নিগমের নির্বাচিত কাউন্সিলার বা প্রশাসক সেজে ছাপোষাদের ওপর দেদার হুকুম চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, বলে অভিযোগ।
শহর দুর্গাপুরের ব্যস্ততম বেনাচিতি লাগোয়া ৫৪ ফুট, শ্রীনগর পল্লী, সারদাপল্লী, জুড়ে বহুতলের বাজার খুলে বসা টিউশন পড়ানো এক মাস্টারদা আবার এখন বেশই কেউ কেটা । তিনিই এখন এলাকার অন্যতম দাদা। কালো গায়ে সোনার গয়না মেখে দাদার এখন জেল্লাটাই আলাদা। শ্রীনগর পল্লী, রাজমহল পাড়া, ৫৪ ফুট এলাকায় ‘দাদা’র হাঁটাচলাও যেমন আলাদা, তেমনি ওই গলিঘুঁজির ভেতরে মুহুর্মুহু দাদার বহুতলের ঠ্যালায় আমজনতার হাঁটা চলাটাও বেশ দায়!
রাজমহল হোটেল লাগওয়া নির্মীয়মান আরেক পাঁচতলার আবাসনেই এখন শহরের ওই দাদার নতুন বিতর্কিত কীর্তি স্পষ্ট দৃশ্যমান। এলাকার লোকজনদের সাফ দাবি, “দাদা ওই বহুতলের নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বৈধ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন টুকুও মনে করেননি। কারণ, পুরসভা, পৌরসভার বর্তমান মালিক, মালকিনরা নাকি সবই তার বুকপকেটে।” আবার এও জানা যায়, উনি একা নন শাসকদলের বেশ কয়েকজনেই রাজমহলের ওই বিতর্কিত বহুতল আবাসনের নাকি গোপন শরীক। বেনাচিতি, প্রান্তিকা, ঝান্ডাবাগ, এলাকার বেশ কিছু সরকারি জমি জবরদখল করেও নাকি মাস্টারদার মসূরীপাট্টা চলছে বলেও অভিযোগ।
কিন্তু লোকে নাকি মুখ খোলে না কলির কেষ্ট ওই ‘মাস্টারদা’র ভয়ে। তিনি আবার এখন ভিরিঙ্গি গ্রামেরই এক খেলার মাঠ গায়ের জোরে দখল করে ‘রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেবার’ হুমকি দিচ্ছেন জমির মালিক, সরিকদেরকে, বলে অভিযোগ। ইস্পাত নগরীর বি জোনের কোভিডে প্রয়াত শাসকদলের এক যুব নেতার সাথে ভিরিঙ্গীর এক প্রতিষ্ঠিত হোটেল ব্যবসায়ীর ওই খেলার মাঠে বহুতল আবাসনের ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছিল, তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কলির নাগর ওই নেতা দাদাই নাকি এখন আসরে নেমে সব হজম করতে নখ দাঁত বের করে হুমকি দিচ্ছেন। একি রকম অভিযোগ বেনাচিটি এলাকার আরো কিছু ব্যবসায়ীর কাছে পাওয়া গেল ওই দাদার বিরুদ্ধেই। রাতের অন্ধকারে তিনি সকলকেই হুমকি দিচ্ছেন – বাঁচতে হলে জমি ছাড়ো, নয় জান ছাড়ো।
জানা যায় মাত্র কয়েক বছর আগেই এই তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনেই এক প্রাক্তন মেয়র বেনাচিতি বাজারের বিপরীতে একটি বেআইনী পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। সেটি ছিল সেখানকার ধুনুরাপ্লট আর লিংক রোড সংলগ্ন এলাকায়। কারণ ওই বহুতলের চার তলার অনুমোদন থাকলেও প্রোমোটার পাঁচতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন — ‘মাস্টার’দার কীর্তি বহুতল গুলির দিকে নগর নিগমের মোটা মাইনের আমলা বা ওজনদার প্রশাসকদের নজর বিশেষ নেই কেন? ওগুলো কিন্তু জবরদখল উচ্ছেদের এই বাজারেও ঠাই দাঁড়িয়ে আছে বিলক্ষণ। দিনের বেলায় বেনাচিতি আর রাত্রে আমরাই গ্রামে নিশ্চিন্তে ‘নিশিযাপন’ করা কীর্তিমান ‘মাস্টার’দার ফন্ধি ফিকির প্রসঙ্গে শহরে এখন কান পাতলেই শোনা যায় অনেক কথা।
এত গুচ্ছগুচ্ছ বেআইনি আবাসন প্রকল্পর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও, নগর নিগমের বর্তমান মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখার্জি বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়েছি, কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর বেনাচিতির জে কে পাল লেনের একটি বহুতল প্রকল্পকে নোটিশও করা হয়েছে। তবে রাজমহল এলাকার একটি প্রকল্প পুর দপ্তরের পোর্টালে অনলাইনে আবেদন করা হয়েছিল। এখনো তার কোন গরমিল মেলেনি আমাদের হিসেবে। তবে তল্লাশি চলবে।”
নেই? সত্যিই কি কোন গড়মিল নেই? তাহলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ‘মাস্টার’দা রাজমহলের ওই বহুতলে যেন তেন প্রকারে হঠাৎকরে রং লাগিয়ে লোক ঢোকাতে তবে উঠে পড়ে লেগেছেন কেন? তাকে কি তবে এই বুদ্ধি নগর নিগমের কোন কেউ কেটাই দিল ? উত্তর দেবে সময়।