মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: নিছকই ১০ ফুট ২০ ফুটের রাস্তা খালি করতে এত লোকলস্কর, যন্ত্র দানব সঙ্গে করে শহরজুড়ে উচ্ছেদ অভিযানের নেপথ্যে আসলে কি রয়েছে আলাদা কোনো গোপন রহস্য? তাই কি কোন আলাপ আলোচনা ছাড়াই বিকল্প পথের সন্ধান না করে, কোন এক মহাশক্তিধর গুজরাটি বাণিজ্য গোষ্ঠীকে জমি পাইয়ে দিয়ে খুশি করতেই কি তবে শিল্পাঞ্চল জুড়ে ইদানিংয়ের এই তড়িঘড়ি উচ্ছেদের তাণ্ডব?
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারের আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা দুটি শহরের পৌরনিগম গুলিকে বগলদাবা করে মাসাধিককাল যাবত দেদার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো জায়গা বুঝে কাউকে কাউকে বিশেষ ছাড় দিতে আচমকা, সেই অভিযান আবার হঠাতই বন্ধও করে দিচ্ছে। বাছাই করা এই উচ্ছেদ নিয়ে শহর জুড়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, আনাচেকানাচে বাড়ছে বিতর্কও। ইস্পাত নগরীর চিহ্নিত কয়েকটি জায়গায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের নামে কোথাও কুড়ি ফুট তো কোথাও তিরিশ ফুটের জায়গা খালি করতে নামা এই আজব অভিযানের ধরনধাঁচন নিয়েও তাই প্রশ্ন উঠেছে – ‘এই উচ্ছেদ অভিযান কি আসলে নেপথ্যে থাকা কেন্দ্রের কোন এক বিশেষ বন্ধু বাণিজ্য গোষ্ঠীকে সরকারি লোকবল, সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতেই?’ এ প্রশ্ন এখন ইস্পাত নগরীর লোকের মুখে মুখে ফিরছে। বিষয়টি নিয়ে সন্ধিহান দুর্গাপুর ইস্পাতের শ্রমিক সংগঠন গুলি কর্তৃপক্ষের কাছে এই মর্মে কৈফিয়ত তলবও করতে চলেছে। শ্রমিক সংগঠন গুলির সাফ কথা – ‘বাঙালির বড় উৎসব দুর্গাপুজো। ঠিক তার মুখেই গরিব হকারদের পেটে কষিয়ে এমন লাথি মেরে কর্তৃপক্ষ কি দিল্লি সরকারের বিশেষ গুজরাটি বন্ধুকেই আসলে ‘পুজোর বোনাস’ উপহার দিতে চাইছে?’ ডান-বাম, শাসক-বিরোধী সব সংগঠনেরই এখন টনক ন়ড়েছে এই কুড়ি ফুট ত্রিশ ফুটের চক্করে। তাইতো গত তিনদিন ধরে অভিযানের কেতা নিয়ে তীক্ষ্ম নজরে ইঞ্চি ইঞ্চি জল মাপছেন তাদের নেতৃত্ব। কিন্তু, এই জল মাপার পর আদতে কি পেলেন শ্রমিক নেতারা?
“গরিবের পেটে লাথি মেরে যে উচ্ছেদ, আমরা বরাবরই তার বিরুদ্ধে। কিন্তু, উৎসবের মুখে এমন বাছাই করা উচ্ছেদ নিয়ে আমাদের মনে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ বাড়তে থাকে। শুরু করি খোঁজ নেওয়ার,” বলে জানালেন ইস্পাত কারখানার সিটু ইউনিয়নের সভাপতি বিশ্বরূপ ব্যানার্জি।
উল্লেখ্য, গত ১৭ই আগস্ট ইস্পাতের শহর জুড়ে অগোছালো এই উচ্ছেদ নিয়ে এক দফা পথেও নেমে সিটু বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ডিএসপির নগর প্রশাসনের দফতরের সামনে। বিশ্বরূপ এদিন বলেন আমরা জানতে চেয়েছি – হঠাৎ করে এখন এই উচ্ছেদ কেন? এর উদ্দেশ্য কি? ওরা এখনো কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। সামনের সপ্তাহে ফের আমরা যাবো। চিঠি দেব। কারণ আমাদের কাছে এরকম গোপন তথ্য এসেছে যে আসলে আদানি গোষ্ঠীর গ্যাস পাইপলাইন ইস্পাতের টাকায়, ইস্পাতের জমিতে নিশ্চিন্তে চুপিচুপি বিছিয়ে দেওয়ার জন্যই এই অভিযান। এ নিয়ে আমাদের বিস্তর প্রশ্ন আছে।” তিনি বলেন, “কোন আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ওরা ওদের গোপন এজেন্ডা পূরণ করতে চুপিসারে এমন সব পরিকল্পনা করেছে বলে সন্দেহ করছি আমরা “
ওদিকে, প্রায় সিটুর সুরেই একই প্রশ্ন ইস্পাতের তৃণমূল কংগ্রেস অনুমোদিত আইএনটিটিইউসির সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত রক্ষীতের। তার অভিযোগ, ” ওদের এই হঠাৎ করে ভাঙচুরে নামার ধরন দেখে আমাদের সন্দেহ বাড়ছে। আমরাও দেখছি জায়গায় জায়গায় কিছুটা করে ভাঙচুর চালিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে। এমনটা কেন?” তিনি আরো বলেন, “গরীব মানুষের রুজি রোজগারের প্রশ্নে আমরা আমাদের সংগ্রামের পথ বেছে নেব ঠিকই, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেমন চুপি চুপি সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহার করে কোন বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করে মানুষের ব্যবসা উচ্ছেদ করবে তা এখানে চলবে না।” বাস্তবে যুযুধান শাসক বিরোধীর সন্দেহের তীর এক্ষেত্রে কিন্তু একই দিশায় বিদ্ধ করেছে ডিএসপিকে।
কি বলছে তবে জাতীয় কংগ্রেস? পশ্চিম বর্ধমান জেলা কংগ্রেসের সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তীর সরাসরি অভিযোগ, “প্রধানমন্ত্রীর পেয়ারের গুজরাটি ওই শিল্পপতিকে খুশি করতে রাস্তা কাটতে সংস্থার লোকবল, গাড়ি, বুলডোজার ব্যবহার হচ্ছে ন্যাক্কারজনক ভাবে। কংগ্রেস চিরকালই এসব তেলা মাথায় তেল দেওয়ার বিরুদ্ধে। আমরা সব লক্ষ্য রাখছি।” তার স্পষ্ট হুশিয়ারি,”সামনের সপ্তাহের মধ্যে এমন বেছে বেছে উচ্ছেদ নিয়ে পস্টাপস্টি কথা না বললে, বিষয়টি খোলসা না করলে সমস্যায় পড়বে ডিএসপি।” ইস্পাত নগরীর সি জোন, বেনাচিতি বাজার সংলগ্ন প্রান্তিকা এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানে নেমে রাস্তার গা বরাবর কুড়ি বা তিরিশ ফুট দখলদারি হাঁটিয়েই চুপি চুপি সরে পড়েছে ডিএসপির উচ্ছেদ অভিযানের কর্মকর্তারা। একই অবস্থা শহরের ভগত সিং মোড় এবং সিটি সেন্টার এলাকায়। সর্বত্র একই ছবি। জংশন মল, চতুরঙ্গ ময়দান এলাকায় লোকদেখানো আংশিক উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে বেছে বেছে কিছু নির্মাণকে অজ্ঞাত কারণে রেহাই দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদের নামে পূরনিগম ও এডিডিএ’র বুলডোজার দেখে গোড়ায় আঁতকে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হকারদের একাংশ এখন বলছেন, “এটা ঠিক উচ্ছেদ অভিযান নয়। ওরা আসলে রাস্তার পাশের জায়গা কিছুটা করে খালি করতে পথে নেমেছে।” ডিএসপি’র ই শুধু নয়, এমন ‘ধরি মাছ, না ছুই পানি’ এডিডিএ’রও বলে সম্প্রতি দেখা গেছে। শহরের ব্যস্ত বেনাচিতি বাজারের রাস্তার দুপাশের দোকান ঘর গুলির সামনে থেকে কয়েক ফুট করে ভেঙে দেওয়া যেমন হয়েছে তেমনি শহরের জংশন মল লাগোওয়া কিছু হকারের দোকান ঘর গুঁড়িয়ে দিলেও দেদার ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছে কিছু কিছু পাকা পোক্ত নির্মাণ, যা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন, অসন্তোষ শহর জুড়েই। আবার, সিটি সেন্টারের চতুরঙ্গ ময়দান সংলগ্ন এলাকায় ঢুকতেই পারল না সরকারি বুলডোজার! ঘোষণা করেও হঠাৎ উচ্ছেদ অভিযান প্রত্যাহার হল বামুনাড়া, আড়া এলাকায় এবং বিধাননগরের একাংশে। কেন? তাহলে কি রাজ্য সরকারি সংস্থা আর ডিএসপি যৌথভাবে আসলে কেন্দ্রের কোন গোপন এজেন্ডা পূরণ করতে অভিযানের নামে প্রহসনে নেমেছে? এডিডিএ’র চেয়ারম্যান কবি দত্ত এদিন বাছাই করা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে বলেন, “আমার কাজ আমি করছি। এ নিয়ে আমি আর কোন মন্তব্য করছি না।” ডিএসপি কর্তৃপক্ষের নবনিযুক্ত নগর প্রশাসক একে দত্ত চৌধুরী অবশ্য এদিন এ প্রসঙ্গে কোন মন্তব্যই করেননি।