মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে শুধু কথা বলার অপেক্ষা ছিল, তার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই তারই দলের ভেতর থেকে লোহা চোর ধরলো পুলিশ। যা নিয়ে এবার শোরগোল দুর্গাপুরের রাজনৈতিক মহলে। মুখ লুকাচ্ছেন ছোটো, বড়ো সব নেতা থেকে হাফ নেতা। কেউ কেউ দুর্গাপুর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন, বলে একটি সূত্র জানাচ্ছে।
শাসক দলের পাশাপাশি পুলিশের ভেতরই চোর আছে কিনা, শুরু হয়েছে তার তত্ত্বতালাশও। ইতিমধ্যেই অবৈধ কয়লা কারবারের অন্যতম গঢ় বারাবনি থানার ওসিকে ‘কর্তব্যে গাফিলতি’র মতো পোশাকি অজুহাতে পদচ্যুত করে সাসপেন্ড করা হয়েছে। নজরে আরো অন্ততঃ চারজন। দুদিন আগেই কিছু গড়বড় বুঝে সরানো হয়েছে জামুড়িয়া থানার ওসিকেও। মুখ্যমন্ত্রীর সপাটে ‘পুলিশও চুরিতে জড়িত’ অভিযোগের পরপরই কি এবার চোরদের মাসতুত ভাই খুঁজতে মরিয়া পুলিশ?
গতকাল বিকেলে নবান্ন সভাগৃহে থেকে রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অবৈধ লোহা, বালি, কয়লা সিন্ডিকেটের কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন রাজ্যের শীর্ষ পুলিশকর্তাদেরকে। সেই মতো গোটা পশ্চিম বর্ধমান জেলা জুড়ে একাধিক জায়গায় অবৈধ লোহা, বালি, কয়লা কারবারের সাথে যুক্ত চোরদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযানও শুরু হয়েছে। সূত্র মারফত জানা গেছে, পশ্চিম বর্ধমান জেলার কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজনের বাড়ি, অফিস ও গুদাম ঘরে ইতিমধ্যেই তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গত রাত থেকেই পশ্চিম বর্ধমান জেলা জুড়ে অবৈধ কয়লা সিন্ডিকেটের কারবারীরা গা ঢাকা দিতে শুরু করেছেন, বলে জানা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্গত বারাবনি থানার পুলিশ আধিকারিক মনোরঞ্জন মন্ডলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু করা হয়েছে, বলে জানা গেছে। শিল্পাঞ্চল আসানসোল, দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ জুড়ে যে অবৈধ কয়লা সিন্ডিকেট এতদিন ধরে রাজত্ব করে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে এবার অভিযানে নেমেছে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল। বেশ কয়েকজন কুখ্যাত কয়লা মাফিয়াকে টার্গেট করে এগোচ্ছে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের বিশেষ তদন্তকারী দল বলে সূত্র মারফত জানা গেছে। শুধু কয়লাই নয় অবৈধ লোহা ও বালী কারবারের সাথে যুক্ত থাকা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রে।
অন্যদিকে গতকাল রাত্রে স্থানীয় কোকওভেন থানার পুলিশ আধিকারিকরা দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের দুই তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে। দুজনের বিরুদ্ধে অবৈধ লোহা কারবারে সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র মারফত জানা গেছে ধৃতরা হলেন প্রাক্তন কাউন্সিলার অরবিন্দ নন্দী এবং প্রাক্তন কাউন্সিলর প্রিয়াংকা পাঁজার স্বামী শুভাশিস পাঁজা ওরফে রিন্টু। বর্তমানে রিন্টু পাঁজা তৃণমূল কংগ্রেস তিন নম্বর ব্লকের সহ-সভাপতি পদে বহাল রয়েছেন। ওই দুই তৃণমূল কর্মীকে আজ দুর্গাপুর মহকুমা আদালতে পেশ করে পুলিশি হেফাজতের জন্য দাবি জানাচ্ছে পুলিশ, বলে সূত্র মারফত জানা গেছে। তবে, তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার চুরি, চুরির বস্তু হেফাজতে রাখা আর অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করে পুলিশ বলেছে, এরা একটি ঠ্যালা ভ্যানে কোকওভেন থানা এলাকার একটি বেসরকারি লোহা কারখানা থেকে রাতের অন্ধকারে লোহা চুরি করে যখন পালাচ্ছিল, তখনই পুলিশের পেট্রোলিং ভ্যান তাদের পাকড়াও করে। রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি তাদের দুজনকে জেরা করতে পারে, বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্গত আরো চারজন থানার অফিসার ইনচার্জ এর বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বলে একটি সূত্র মারফত জানা গেছে। ইন্সপেক্টর পদ মর্যাদার ওই আধিকারিকদের বিরুদ্ধে খুব তাড়াতাড়ি করা পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং রাজ্য গোয়েন্দা বাহিনী সিআইডির জেরার সম্মুখীন হতে হবে তাদেরকে, বলে একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টভাষায় হুশিয়ারি দেওয়ার পর থেকেই নড়ে চড়ে বসেছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিকরা। আজ সকাল থেকেই শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে।
এদিকে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের খুব নিকটে পাণ্ডবেশ্বর থানা ও জামুরিয়া থানা এলাকার বিরকুলটি, শ্যামলা ও বেশ কয়েকটি ঘাটে চলছে রমরমিয়ে অবৈধ বালির কারবার। সূত্র মারফত জানা গেছে প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ ট্রাক, ডাম্পার ও লরি অবৈধ বালির অবৈধ চালান নিয়ে ওই ঘাট গুলি থেকে বের হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। কলকাতার এক প্রভাবশালী ব্যবসাদার ‘পবন’ এর সাগরেদরা নাকি মহাভারতের ধর্ম পুত্র স্থানীয় ‘যুধিষ্ঠির’ নামক এক ব্যক্তি ও দুর্গাপুরের কাঁকসা এলাকার কুখ্যাত অবৈধ বালি মাফিয়া ‘গৌতম’ এর গুন্ডাবাহিনীর সাহায্যে প্রতিদিন কয়েকশো গাড়ি অবৈধ বালি অবাধে লুঠ করে চলেছে অজয় নদের বুক থেকে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের একাংশ এই অবৈধ লোহা,বালি ও কয়লা পাচারের সাথে যুক্ত বলে জানা গিয়েছে। শুধু পুলিশ প্রশাসনের নিচু তলার কর্মীরাই নয়, একটি বিশ্বস্ত সূত্র মারফত জানা গেছে পশ্চিম বর্ধমান জেলার জেলাশাসকের দপ্তরেও প্রতিমাসে নিয়ম করে নাকি কলকাতা থেকে ওই কুখ্যাত বালি ব্যবসায়ী ‘পবন’ আসেন তার নাজরানা দিতে ওই অফিসের উচ্চ আধিকারিকদেরকে। যা সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে জেলাশাসকের দপ্তরে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা যাচাই করলেই বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।
এখনো পর্যন্ত আর কোন গ্রেফতারি বা সাসপেনশনের খবর এসে পৌঁছায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর এখন শিল্পাঞ্চলে এই অবৈধ লোহা, বালি, কয়লা সিন্ডিকেট রাজ বন্ধ হয় কিনা সেটাই দেখার।