মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:– চতুরঙ্গ মাঠে ডেঙ্গু চাষের বিতর্কিত সেই জলাশয়টি বুলডোজার লাগিয়ে রবিবার সকালে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল দুর্গাপুর নগর নিগম। এদিন সকাল-সকালই সিটিসেন্টারের বহুল চর্চিত চতুরঙ্গ ময়দানের ভেজা মাঠে মত্ত ঐরাবতের মত দাপিয়ে বেড়ালো পুরসভাযর সরকারি বুলডোজার, যার জেরে মুখ পুড়লো সরকারি পুরস্কার প্রাপ্ত জাঁকজমকের চতুরঙ্গ পুজো কমিটির।
এদিন অসহায়ের মতো গালে হাত রেখে ওই পুকুরের করুণ ধ্বংসযজ্ঞ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন শহরের মহার্ঘ পুজোর উদ্যোক্তারা। তবে, এদিনও কিন্তু আড়ালে মুখ লুকিয়েই রইলেন পুজোর ডাকসাইটে কেষ্টবিস্টুরা।
“অন্য কোন উপায় না দেখে, আর দেরি না করে রবিবার সকালেই আমরা পুরনিগমের বুলডোজারটি পাঠিয়ে ওই জলাশয়টি ভেঙে দিলাম। ওদের কমিটি অবশ্য কয়েকজন লেবার দিয়েছিল। এছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না,” বললেন রাখি তেওয়ারি। তিনি দুর্গাপুর নগর নিগমের বর্তমান স্বাস্থ্য-প্রশাসক। তিনি বলেন, “এটা করার দরকারই হতনা, যদি ওরা একটু সচেতন হোতো। ওরা অনেক বেশি সময় পেয়েছিল।” তার আরো দাবি, “সেই জমা জলই যখন আর নেই, ওখানে ডেঙ্গু নিয়ে আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে, আমরা নজর রাখছি।” পুরনিগম অবশ্য সোমবারই পুজো কমিটিকে সরকারি চিঠি ধরিয়ে এবার পুকুর ভাঙ্গার খরচ বাবদ বুলডোজার কস্ট চেয়ে পাঠাবে, বলে জানালেন রাখী তেওয়ারি।
মশা মাছি সঙ্গে নিয়ে চতুরঙ্গ মাঠের বিতর্কিত সেই জমা জল শেষে মরলো। তবে, জল মরলেও নতুন করে চাগাঢ় দিল আলাদা বিতর্ক – যার কেন্দ্রবিন্দু প্রভাবশালীদের জাঁকজমকের ওই দুর্গাপুজো।
পুচকে ওই পুকুরটির জল একমাস ধরে বেআইনি ভাবে জমা রেখে, তাতে দেদার ডেঙ্গু চাষ করল চতুরঙ্গ পুজো কমিটি, আর এক বেলায় একটু বিতর্ক দানা বাঁধতেই মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ওই জল কোন ঐশ্বরিক জাদুবলে বেমালুম উধাও হল – এ প্রশ্নে রবিবারের সকাল থেকেই শহরজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তাতে নাক গলিয়েছে শাসক বিরোধী রাজনৈতিক দলের দুটি পক্ষই। যেমন বলেছেন বিজেপির দুর্গাপুরের সুশাসন বিভাগের প্রধান অমিতাভ ব্যানার্জি। তার কথায়, “ওদের চৈতন্য ফিরেছে তা ভালো কথা। কিন্তু, এতদিন ওরা কি করছিল? এত নাম ডাকওয়ালা পুজো যার আবার মাথায় বসে শহরের কেষ্ট বিষ্টুরা, তাদের কাছে কি এমনটা প্রত্যাশিত ছিল?” অমিতাভর দাবি, “খোদ রাজ্য সরকার ডেঙ্গু নিয়ে এত ব্যবস্থার ব্যস্ততা দেখাচ্ছে আর সিটি সেন্টারের বুকে চতুরঙ্গ মাঠে এই ঢালাও ডেঙ্গু চাষ আসলে ওদের উদারশীনতা নয় চরম ঔদ্ধত্যেরই প্রমাণ। ওদের ধারণা ওরা যা চাইবে করবে আর শহরবাসী মাথা নিচু করে হাততালি দেবে। কারণ অনেক বড় বড় লোক এখন ওদের কমিটির মাথা।”
শহরের অন্যতম নামী সিটিসেন্টারের চতুরঙ্গ কমিটি এবার তাদের পুজোর থিম করেছিল গুজরাটের নীলকন্ঠ মন্দির। প্যান্ডেলের কাঠামোর ওই মন্দিরের ভেতরেই লাইভ জলাভিষেকের জন্য ছেলেদের খেলার মাঠটি কেটে খনন করা হয়েছিল ৪০০ বর্গফুটের একটি পুকুর। দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে ওই পুকুরের পাড়ে চলে টানা জলাভিষেক। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় গত ৫ অক্টোবর ওই পুজোর উদ্বোধন করেন, যা শেষ হয় ন’দিন পর গত ১৪ অক্টোবরের সরকারি কার্নিভালে। বিসর্জন হয় দেবী প্রতিমার। কিন্তু, এতসত্বেও ৯ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত জলভরা ওই পুকুরটি বহাল তবিয়তে মাঠের বুকে বিরাজ করতে থাকে স্বমহিমায়।
এদিকে, সরকারি নির্দেশে স্বাস্থ্য দপ্তর ও পুরসভার কর্মীরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইতিমধ্যে বাড়ি বাড়ি অভিযান শুরু করেন। ফরমান জারি করে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় – বাড়িতে জমা জলের অস্তিত্ব মিললে গৃহস্থকে নোটিশ দিয়ে তার নামে জরিমানা চার্জ করা হবে। শহরের বিধাননগর, সিটিসেন্টার, পলাশডিহা, করঙ্গপাড়া, সগড়ভাঙ্গা, বেনাচিতি সহ অজস্র পল্লী, পাড়া এলাকায় এমন নির্দেশ জারি হতেই সামনে আসে চতুরঙ্গ কমিটির লালন পালন করা সাধের ওই জলাশয়টির বিষয়। শনিবারই বিষয়টিতে আলোকপাত করে ‘চ্যানেল এই বাংলায় ডট কম’ আর তারপরেই হইচই পড়ে যায় চতুরঙ্গ দুর্গাপুজো কমিটির অন্দরে। ওই কমিটির প্রধান ব্যবসায়ী কবি দত্ত আবার পদাধিকার বলে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান। যে এডিডিএ’র জনগণের স্বাচ্ছন্দ দেখার কথা, তারাই যদি ডেঙ্গু চাষের আতুর ঘর নিয়ে এতটা উদাসীন থাকে তাহলে পুরো নিগমই বা কি আর করতে পারে! তবে, কবি নিজের মুখেই শনিবার কবুল করেন, কাজটা ভুল হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম,। ওরা কেন এসব দেখেনি খোঁজ নিচ্ছি “
কবি দত্ত খোঁজ নিতেই টালমাটাল চতুরঙ্গ এলাকা। হন্তদন্ত হয়ে পুজো কমিটির আধুলি, সিকি’রা গামছা বেঁধে নেমে পড়েন পড়লেন জলাভিষেকের পুষ্করিণী নিধন যজ্ঞে। সিটিসেন্টার সংলগ্ন কলাবাগান বস্তি থেকে ভাড়া করে আনা হলো তিনজন মহিলা মজুরকে। বালতি হাতে তারা শনিবার বিকেলেই নেমে পড়েন পুষ্করিনীটির জল মারার কাজে। আর তড়িঘড়ি লাগানো হলো এতদিন খুঁজে না পাওয়া কবি দত্তর সেই ‘ মেশিন’ – যা আদতে একটি ছোট্ট জল তোলার টুলু পাম্প। “যে কাজ এক মাসে হল না সে কাজ একদিনে তবে হলোটা কি করে?” – প্রশ্ন প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা তরুণ রায়ের। এর জবাব রবিবার চতুরঙ্গ কমিটির কেউ সরাসরি না দিলেও কমিটিরই জ্যোতির্ময় ভৌমিক অবশ্য এদিন ঝাঁঝের সাথে বলেন, “পুকুরের জল মেরে দেওয়া হয়েছে এসে দেখে যান!” দুর্গাপুরের চতুরঙ্গ পুজো কমিটির ওই পুকুর ভাঙ্গা জল আবার শনিবার শুরু হওয়া জগধাত্রী পুজোর প্যান্ডেলের একাংশ ভাসিয়ে দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।