eaibanglai
Homeএই বাংলায়দুর্গাপুর উৎসব মঞ্চে বিবাহবার্ষিকী, দায় নিলেন না মন্ত্রী, দিপুরই, ভক্তরাই ভাইরাল করলো...

দুর্গাপুর উৎসব মঞ্চে বিবাহবার্ষিকী, দায় নিলেন না মন্ত্রী, দিপুরই, ভক্তরাই ভাইরাল করলো ভিডিও

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- মঞ্চ এক, ছবিটাও প্রায় এক, ফারাকটা শুধু দিন, তারিখ, বছরের, আর অবশ্যই দেখার নজরের।

আরোও বড় ফারাক লোকের বিচারের। নাহলে, যারা মাত্র একটি বছর আগে গ্যাঁটের কড়ি গুণে ঢাউস একটি কেক কিনে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ঘটা করে দুর্গাপুর উৎসবের মঞ্চ দাপিয়ে মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়’র জন্মদিন পালন করলেন, এবছর তারাই হঠাৎ ওই মঞ্চে শহরের এক নগর প্রশাসক দীপঙ্কর লাহার জন্য একটি কেক কাটায় হৈ হৈ করে গেলো গেলো রব তুলছেন, নাক সিঁটকে বলছেন – ‘ছিঃ ছিঃ অপসংস্কৃতির নজির গড়ল দুর্গাপুর উৎসব। এসবও কি মেনে নেওয়া যায়! সব রসাতলে গেলো।’

প্রাক্তন পুরপিতা দীপঙ্কর লাহা দুর্গাপুর নগর নিগমের একজন প্রশাসক। তার স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা স্থানীয় একটি মিউজিক গ্রুপের অন্যতম প্রধান গায়িকা, পরিচালিকা। এবারের দুর্গাপুর উৎসবের অন্যতম ধারকও আবার দীপঙ্কর লাহা, আর ওই উৎসবের মঞ্চেই শনিবার সন্ধ্যায় ছিল প্রিয়াঙ্কার গানের অনুষ্ঠান। বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে পরপর একটানা গেয়ে মঞ্চ মাতিয়ে দিলেন প্রিয়াঙ্কা। হাততালির পর হাততালি। ওখানেই দর্শকাসনে বসে দীপংকর নিজেও। স্ত্রীর সঙ্গীতের মূর্ছনায় মোহিত তিনি নিজেও। মুচকি হেসে, হাত নেড়ে আকারে ইঙ্গিতে মঞ্চের প্রিয়াঙ্কার সাথে চলছে তার ভাব বিনিময়। এমন সময় আচমকা ছোট্ট একটি ঘোষণায় যেমন চমকে উঠলেন দীপঙ্কর, তেমনি পড়ে গেলেন ভীষণ লজ্জাতেও। কারণ, প্রিয়াঙ্কার গানের শেষে মঞ্চ থেকে হঠাৎই ঘোষণা হচ্ছে দীপঙ্করেরও নাম, আর লোকসমক্ষে ওই মঞ্চে তাকেও ডাকা হচ্ছে কেক কাটতে। কারণ ওদিনটাই যে ছিল আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদারকম, তাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন!

ইতস্তত ভাব কাটিয়ে দীপংকর উঠে গেলেন মঞ্চে, স্ত্রীর হাতধরে একসাথে কেক কাটলেন লাজুক মুখে। সঙ্গে সঙ্গে ফের জনতার করতালি!

একটি নিটোল প্রেমের ছোটো গল্পের এখানেই হতে পারতো মধুরেনসমাপয়েৎ! কিন্তু, এবারের উৎসবটা যে রাজনীতির জটিল অংকের আবর্জনায় ভরা কাদা ছোড়াছুড়ির খোলা ময়দান! বিরোধী শূন্য শহরে ‘সবার হাতেই কাঠি’, কে কাকে কোথায় বধ করবে, চলছে তার দুরন্ত লড়াই।

অনুষ্ঠানের শেষে, দীপঙ্কর – প্রিয়াঙ্কা তাদের বাড়ী বিধাননগর পৌঁছনোর আগেই ভাইরাল হয়ে গেলো কেক কাটার ভিডিও, আর তার সাথে চোখা চোখা কমেন্ট, তাচ্ছিল্য, হায় হায়! শাসক তৃণমুল কংগ্রেসের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে এরকম ভিডিও পোস্ট করে মন্ত্রীর পেয়াদাদের ‘প্রদীপ মজুমদার ফ্যান ক্লাব’ পেজে এই কেক কাটার ঘটনাকে ‘আজ দুর্গাপুরের লজ্জা ‘ বলে উল্লেখ করেছে, হাহুতাশ করেছে ছত্র ছত্রে। কটাক্ষ করা হয়েছে কেক কাটার আসরে লাল সোয়েটারের এক বিতর্কিত, জেল ফেরত যুবকের হাত দিয়ে মোমবাতি জ্বালানোয়। শাসক তৃণমুল কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের একাংশের দাবি, এইসব উটকো ‘দেবতার টুকরো ‘ দাগীরা আর তাদের জুড়িদার এক ঠিকাদার বিগত দুবছর ধরে নাকি দীপঙ্করের নানান অধঃপতনের আসল কারণ।

কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর কেক কাটায় এতোইবা কিসের লজ্জা? মন্ত্রীর ভক্তদের ফেসবুক পেজের যুক্তি আর তাদের ব্যাখ্যা, ‘দুর্গাপুর উৎসব আর জনসাধারণের নয়, উৎসবের মঞ্চ এখন বিবাহ বার্ষিকীর আসর।’ এনিয়ে বিব্রত দীপংকর বলেন, “একটা সাধারণ বিষয়কে নিয়ে দেখছি এসব নোংরামো শুরু হয়েছে। কেনো যে এসব করে এরা?”

দীপঙ্কর লাহা নিজের বিবাহবার্ষিকী দুর্গাপুর উৎসব মঞ্চে উদযাপনকে ‘একটি সাধারণ বিষয়’ বলে আখ্যা দিলেও, তা কিন্তু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না দুর্গাপুর উৎসবে ব্যবসার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বিভিন্ন সংস্থার স্টল ও বিপনীর মালিকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু স্টলের মালিক জানান, “তৃণমূল নেতা তার স্ত্রীকে যে কতোটা ভালোবাসেন তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য দুর্গাপুর উৎসবের মঞ্চ ব্যবহার করা ঠিক ছিল কি? গত বছর দুর্গাপুর উৎসবে আমরা এখানে দোকান দিয়ে ভালো রোজগার করেছিলাম। এবছরও আমরা মাননীয় মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি দত্তের মতন ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি দেখে আশা করেছিলাম এবারে আমাদের বিক্রি বাট্টা আরো বাড়বে। কিন্তু, না। অভুক্তই রইল আমাদের সন্তানেরা, আর ওনারা মঞ্চে কেক কেটে বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করলেন।” তাদের মতে, “প্রতিদিনের ইলেকট্রিক, স্টল ভাড়া ও আমাদের নিজস্ব কর্মীদের খাওয়া-দাওয়া বাবদ খরচ হচ্ছে বহু বহু টাকা। কিন্তু বিক্রি বাট্টা নেই বললেই চলে। আমাদের কাছ থেকে বলপূর্বক টাকা নিয়ে উদ্যোক্তারা যদি নিজেদের বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করার জন্য মেলা আয়োজন করে থাকেন, তাহলে তা আমাদের দুর্ভাগ্য। মেলার উদ্বোধনীর দিন থেকে আমরা যাদেরকে বিশ্বাস করে এই মেলায় স্টল বুকিং করেছিলাম সেই মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি দত্তের একবারও দেখা যায়নি আমাদের স্টলগুলির আশেপাশে। এক কথায় অভিভাবকহীন দুর্গাপুর উৎসব চলল এবছর আর মাঝখান থেকে মরলাম আমরা।”

দুর্গাপুর উৎসব সিজন টুয়ের অরাজকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে বিরোধী দল বিজেপি। কয়েকদিন আগেই দুর্গাপুর উৎসব প্রাঙ্গণে বাংলাদেশী পতাকা লাগিয়ে শাড়ি বিক্রি করার অভিযোগ তুলে এক বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হন দুর্গাপুর পশ্চিমের বিধায়ক লক্ষণ ঘড়ুই। গত ৯ ডিসেম্বর দুর্গাপুর উৎসব কমিটির বিরুদ্ধে দুর্গাপুর থানায় এফআইআর দায়ের করেন বিজেপি নেতা জিতেন চ্যাটার্জি। দুর্গাপুর উৎসব কমিটির অফিসে দুর্গাপুরের সাধারণ মানুষ বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। দুর্গাপুর উৎসবকে কেন্দ্র করে বাম-ডান সব দলেরই একই সুর, “এবারের দুর্গাপুর উৎসব দুর্গাপুরের লজ্জা।”

স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মী ক্ষোভের সাথে জানান, “দুর্গাপুর উৎসব সিজন-২ এর প্রথম দিন থেকেই যে দলাদলি , কাদা ছোড়াছুড়ি, নোংরামি শুরু হয়েছিল। তা দেখে আমরা বুঝেই গিয়েছিলাম যে এবছর দুর্গাপুর উৎসব পুরোটাই ফ্লপ শো । সাংবাদিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, ভিআইপি পাস নিয়ে সজন পোষণ, ভলেন্টিয়ারদের উৎশৃংখল আচরণ ও সর্বোপরি নেতৃত্বহীন দুর্গাপুর উৎসব এবার তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে। আগামী বছরে আমরা আর কোন ভাবেই দুর্গাপুর বণিকসভার কোন মানুষকেই এই দুর্গাপুর উৎসব পরিচালনার দায়িত্বে রাখবো না ঠিক করে নিয়েছি।” তাদের কথায়, “একটা কথা না বলে পারলাম না যে দীপঙ্কর লাহার মতন একজন ভদ্র, মৃদু ভাসি জননেতার এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ মোটেও ভালো চোখে নিলোনা দুর্গাপুর বাসী।” তারা দীপঙ্করের গত দুবছরে দুর্গাপুর ইস্পাতে এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া নিয়েও ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু অনরেকর্ড মন্তব্যও করেছেন, প্রকাশ্যে।

মন্ত্রীকে খুশি করতে করা ওই ফ্যান পেইজটির অন্যতম নিয়ন্ত্রক নাকি শহরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আরেক প্রাক্তন কাউন্সিলর রমাপ্রসাদ হালদার। তিনি এনিয়ে রবিবার আলাদা করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে, মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেন, “কেনো এসব করলেন ওনার তা ঠিক জানিনা। এসব তো নিছক পারিবারিক বা সামাজিক একটা অনুষ্ঠান। এটা পরিবারের মধ্যেই করলে ভালো হতো। জানিনা, ওনার এসবের কোনো অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা!” মন্ত্রী আরো বলেন, “যারা উৎসব করছে তারা বুঝবে। আমিতো বেশিরভাগ সময় থাকতে পারিনা, ভাই নরেন (বিধায়ক, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) আছেন, উনিই এই উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান। ওনারাই বলতে পারবেন এসবের অনুমোদন আদৌ ছিল কিনা!” উল্লেখ্য, বিতর্কিত কেক কাটার সময় মন্ত্রী নিজে নাকি ভিজিট করছিলেন তার দপ্তরের সিএডিসি স্টলটি।

এরপরই দীপঙ্করের ঘটনা নিয়ে শহরজুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেলেও, অফিসিয়ালি তৃণমুল কংগ্রেস বা উৎসব কমিটি কোনো বিবৃতিই দেইনি। এনিয়ে এদিন বক্তব্য দিতে গিয়েও অজ্ঞাত কারণে মাঝরাত অব্দি আর মুখ খোলেননি নরেন্দ্রনাথও। জল মেপে চলছেন কি শাসক দলের জেলা সভাপতি নিজেও ? উওর দেবে সময়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments