eaibanglai
Homeএই বাংলায়দুর্গাপুর পৌরসভার টোল 'তোলাবাজির' জুলুম বন্ধের আদেশ হাইকোর্টের

দুর্গাপুর পৌরসভার টোল ‘তোলাবাজির’ জুলুম বন্ধের আদেশ হাইকোর্টের

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- হাইকোর্টে নাকখত দেওয়ার পর ফের মাটিতে লম্বা নাক ঘষা!

ভাবাই যায়না – রাজ্যের পূর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের অজান্তেই চুপি চুপি শিল্প তালুকে পণ্যবাহী গাড়ি ধরে ধরে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘দাদা ট্যাক্স’ আদায় করে আসছে দুর্গাপুর নগর নিগম। আর এই ট্যাক্স উসুল করার জন্য টোল আদায়কারী ভাড়াটে বাহিনীও নিয়োগ করেছে পূরনিগম। একে সোজা কথায় বেআইনি ‘গুণ্ডা ট্যাক্স’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে শিল্প কারখানাগুলির নথিকৃত সংগঠন। তাই, এই গুণ্ডা ট্যাক্স অবলুপ্তির জন্য সংগঠন কলকাতা হাইকোর্টে দুর্গাপুর নগরনিগমের বিরুদ্ধে দরবার করেছে।

টেন্ডারের মাধ্যমে দুর্গাপুর শিল্পতালুকের বিভিন্ন মূল রাস্তায় এক প্রকার গায়ের জোরে টোল আদায়ের জন্য ব্যবস্থা ছিল। মূলতঃ শিল্পাঞ্চলের যে সব জায়গায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানাগুলি রয়েছে, সেইসব এলাকায় বেছে বেছে সাতটি অঞ্চলে তথাকথিত টেন্ডারের মাধ্যমে দেদার টোল আদায় করার নাকি একটি অশুভ আঁতাত চলছিল। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে কল-কারখানা গড়ে তোলার জন্য এই টোল আদায় এক বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বলেও দাবি শিল্পপতিদের সংগঠনের। বিভিন্ন কারখানা ও তার মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বহুবার এই অবৈধ রূপে টোল আদায় বন্ধ করার আর্জি জানানো হয়েছিল দুর্গাপুর নগর নিগমকে। কিন্তু, অভিযোগ – ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লাগাতার দিনরাত কয়েক কোটি টাকা টোল বাবদ আদায় করে চলেছে দুর্গাপুর নগর নিগম। যদিও, এই টোল গুলি টেন্ডার এর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, এই টেন্ডার সম্পর্কিত একাধিক দুর্নীতির গল্প শিল্পাঞ্চলের আনাচে-কানাচে ভেসে বেড়াতে শোনা গেছে সময়ে সময়ে। মুষ্টিমেয় কিছু পেটুয়া ঠিকাদারকেই নাকি এই বরাত দেওয়া হচ্ছিল বছরের পর বছর আর এই ব্যাবস্থা কায়েম রাখতে নিযুক্ত ভাড়াটে সংস্থার মালিকেরা নাকি পূরনিগমের বোর্ডের কেষ্টবিষ্টু তো বটেই, কতিপয় আমলা, বস্তুকার, পরিদর্শকদের টেবিলের তলা দিয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিতো মাসে মাসে। তাতে নগরনিগমের বড় থেকে ছোট একাধিক কর্মকর্তা নাকি বেশ আমোদ আহ্লাদেই গতর ফুলিয়ে আসছিলেন। শিল্পাঞ্চলের মানুষের অভিযোগ – একশ্রেণীর মাফিয়া গোষ্ঠীকে টোল আদায়ের জন্য টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল অবৈধ রূপে, এই নগরনিগমের এইসব কেষ্ট বিষ্টুদেরই উদ্যোগে। আবার, এই টোলের দৌলতে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন শাসক, বিরোধী দুই দলেরই বেশ কিছু স্থানীয় নেতা, হাফ নেতা। তাদের এখন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ!

দুর্গাপুর নগরনিগমের লেনিন সরণী, কাঞ্জিলাল এভিনিউ, বনফুল সরণি, নাচন রোড, হ্যানিম্যান সরণিতে রয়েছে দুর্গাপুর নগর নিগমের ৭টি টোল। সেই টোলগুলি থেকে কারখানার পণ্যবাহী গাড়ির টোল নেওয়া হচ্ছিল। দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র শিল্পপতিরা দুর্গাপুর নগর নিগমের কাছে আবেদন করেছিলেন -:১২ টনের নিচে পণ্যবাহী গাড়িতে যাতে টোল নেওয়া না হয়। কিন্তু, সেই আবেদনে কোন সাড়াই দেয়নি নগরনিগম। তারপরেই দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র শিল্পপতিরা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। রাজ্যের পুর ও নগর উন্নয়ন দপ্তরের বিনা অনুমতিতে দুর্গাপুর নগর নিগম টোল আদায় করছে বলে মামলা করেন (ডাবলু পি এ/২৬৮৬৩, ২০২৫)। নতুন বছরের শুরুতেই, গত ১০ জানুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি একটি আদেশে দুর্গাপুর নগর নিগমের অধীনস্থ যতগুলি টোল প্লাজা আছে তার সব কটি বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

এদিন এক প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী সন্দীপ চক্রবর্তী জানান, “গত ১০ জানুয়ারি কলকাতা আদালতের মাননীয় জাস্টিস কৌশিক চন্দ্রা দুর্গাপুর নগর নিগমের অধীনস্থ সাতটি টোল প্লাজা অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু, দুর্গাপুর নগরনিগম কর্তৃপক্ষ আদালতের সেই আদেশ কার্যকর না করায়, আমরা গত তিন দিন আগে দুর্গাপুর নগর নিগমের কমিশনারকে নোটিশ করে জানতে চাই – কেন তারা আদালতের নির্দেশ কার্যকর করছেন না। আমাদের সেই নোটিশ পাওয়ার ঠিক তিন দিনের মাথায় অবশেষে দুর্গাপুর নগর নিগম নাকি উক্ত ওই টোল প্লাজা গুলিকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেছেন বলে জানতে পেরেছি। আরেকবার ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলো। তাই স্বভাবতই আমরা খুশি।”

কলকাতা উচ্চ আদালতের আদেশকে কার্যকরী করতে দুর্গাপুর নগরনিগমের পক্ষ থেকে বুধবার সকাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সব টোল প্লাজা গুলি। বন্ধ হয়ে যায় টোল আদায়ের কাজ। এ বিষয়ে দুর্গাপুর নগর নিগমের প্রশাসক মন্ডলীর চেয়ারপারসন অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, “সরকারি অনুমতি নেওয়ার কথা ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি ঠিক কথা। তবে আমি তো কিছুদিন যাবত এই দায়িত্বে এসেছি। কিন্তু, এই ভাবেই টোল আদায় দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। সরকারি যা নিয়ম আছে সেগুলি জানার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই কলকাতা গিয়েছিলাম। যা যা নিয়ম আছে সমস্ত নিয়ম মেনে আগামী দিনে কাজ করা হবে। তবে, সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপাতত আদালতের রায় মোতাবেক আগামী তিন মাস নগর নিগমের সমস্ত টোল প্লাজা গুলি বন্ধ রাখা হবে। আমরা মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশ মত সমস্ত টোল প্লাজা গুলি আপাতত বন্ধ রাখছি।”

অন্যদিকে বর্ধমান সাংগঠনিক জেলার বিজেপির সহ-সভাপতি চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে বলেন, “রাজ্যের পুর ও নগর উন্নয়ন দপ্তরের অনুমতি ছাড়াই টোল আদায় চলছে। ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্গাপুর নগরনিগমে বোর্ড গঠন হওয়ার পর বাম আমল থেকে একইভাবে তৃণমূল আমল পর্যন্ত এই দুর্নীতি চলে আসছে। এই টোল যে সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত, অবৈধ তা মহামান্য হাইকোর্ট পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন। দুর্গাপুর নগর নিগমের প্রশাসক মন্ডলী শুধু অপদার্থই নয়, দুর্নীতিগ্রস্তও।”

এদিকে, টোল আদায় সকাল থেকে বন্ধ হওয়ার ফলে খুশির জোয়ারে ভাসছে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলি। এদিন দুর্গাপুরের শিল্পপতি রতন আগারওয়াল সহ অন্যান্য শিল্পপতিরা জানান, “আজ সত্যের জয় হল। অন্যায় ভাবে বহুদিন ধরে আমাদের উপর টোল এর নামে জুলুমবাজি হচ্ছিল। কারখানার উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা করতে লাগছিল অতিরিক্ত মাসুল। বেড়ে যাচ্ছিল আমাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম। এখন সহজেই আমাদের পণ্য কম দামে রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাবে। ভিন রাজ্য থেকে যে সকল পণ্যেবাহী যানবাহন এতদিন দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে তাদের পণ্য নিয়ে আসতো, তারাও এই জুলুমবাজির শিকার হতেন। এখন থেকে সর্বভাবে মুক্ত হলাম আমরা। আমরা ভারতীয় সংবিধান ও আইনের ওপর ভরসা রেখেছিলাম, তার ফল পেলাম হাতে নাতে। আজ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো।”

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments