জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গণপুরঃ- পশ্চিম মঙ্গলকোটের গণপুর গ্রামে প্রায় সমস্ত উৎসব হয়। প্রতিটি উৎসব যথেষ্ট ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে রঙের উৎসব দোল যে উচ্চতায় পৌঁছে গ্যাছে তাতে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এটাই হয়তো গণপুরের শ্রেষ্ঠ উৎসব হয়ে উঠবে।
কার্যত করোনা জনিত কারণে অভিশপ্ত দু’টো বছর পর ৭ ই মার্চ দোল উৎসবে মেতে উঠল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধক শ্রী শ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘আনন্দমঠ’ আশ্রমে রঙের উৎসব দোলের আনন্দে মেতে উঠল পশ্চিম মঙ্গলকোটের গণপুর গ্রামের বাসিন্দারা। আট থেকে আশি – কচিকাচা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, গৃহবধূ থেকে শুরু করে বাড়ির মেয়েরা – সবাই এই আনন্দোৎসবে সামিল হয় এবং সবার মিলিত উপস্থিতিতে দোলের উৎসব সত্যিকারের রঙিন হয়ে ওঠে।
নাম সংকীর্তন প্রচার ও মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে হুগলির ডুমুরদহের বাসিন্দা সংস্কৃতের পন্ডিত শ্রী শ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর গণপুর গ্রামের তাঁর তিন শিষ্য শম্ভুনাথ, তারকনাথ ও সুরথনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৩৬০ সালের শ্রাবণ মাসে গণপুর গ্রামে আসেন এবং ‘আনন্দমঠ’ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে চারমাস ধরে যজ্ঞ করেন। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিটি নিম কাঠের তৈরি এবং শোনা যায় স্বয়ং ওঙ্কারনাথ সেটি পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন।
১৩৮৫ সালের ভয়াবহ বন্যায় মাটির ঘরটি নষ্ট হয়ে যায়। ১৪০৯ সালে পরিবারের অন্যতম সদস্য হরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। নতুন মন্দিরকে কেন্দ্র করে সেই বছর দোলের উৎসবে গ্রামবাসীরা মেতে উঠলেও আর্থিক কারণে পরের বছর দোল উৎসব আবার বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে সমগ্র গ্রামবাসীদের উদ্যোগে গত কয়েক বছর ধরে আবার দোল উৎসব শুরু হয়।
উৎসব উপলক্ষ্যে গত ৬ ই মার্চ সন্ধ্যে থেকে মন্দির চত্বরে শুরু হয় নাম-সংকীর্তন এবং ৭ ই মার্চ সারাদিন ব্যাপী সেটি চলে। গ্রামবাসীদের আগমনে মন্দির চত্বর গমগম করে ওঠে। দুপুরে হয় নরনারায়ণ সেবা। পরে গ্রামবাসীরা নগর পরিক্রমায় বের হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে নগর পরিক্রমায় পা-মেলাতে দ্যাখা যায়। পরস্পরকে আবিরে রঙিন করে নাচতে নাচতে সকলে আনন্দে মেতে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে সব ভেদাভেদ দূর হয়ে উৎসব সত্যিকারের সার্বজনীন হয়ে ওঠে।
দোল উপলক্ষ্যে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ হয়ে গ্যাছে। দোলের আনন্দ উপভোগ করার জন্য পাড়ার মেয়েরা শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে এসেছে যেটা সাধারণত দুর্গা পুজোর সময় দ্যাখা যায়। মেলাও বসেছে। এমনকি উদ্যোক্তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে। সব মিলিয়ে এক জমজমাট পরিবেশ।
শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসা পিউয়ের বক্তব্য – দোলকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বন্ধুরা বাপের বাড়ি এসেছে। আবার সবাই আনন্দ করব। এই সুযোগ কি ছাড়া যায়।
গ্রামের অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তি তথা ওঙ্কারনাথের শিষ্য রামজীবন ভট্টাচার্য্য বললেন- ঠাকুরের লক্ষ্য ছিল জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ঠাকুরের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে আর যেন এই মিলন উৎসব বন্ধ না হয়। গ্রামবাসীদের কাছে তার আবেদন ছোট করে হলেও ভবিষ্যতেও এই মিলন উৎসব যেন চালিয়ে যাওয়া হয়। তাহলে সেই মহান মানুষটির ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়া হবে।
একই কথা বললেন আশ্রমের বর্তমান সেবাইত কনকনাথ ব্যানার্জ্জী ও রমা ব্যানার্জ্জী। তাদেরও ইচ্ছে প্রতি বছর যেন এই উৎসব হয়। রমা দেবীর বক্তব্য – আমার যা আর্থিক ক্ষমতা তাতে আমার পক্ষে উৎসব করা সম্ভব নয়। তবে যেভাবে গ্রামবাসীরা এগিয়ে এসেছে তাতে ব্যানার্জ্জী বাড়ির বধূ হিসাবে আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নীলকুমার, উদয়, তাপস, নগন, সাহেব, শিউলি, পাপিয়া, অর্ণবী, অনিমেষ প্রমুখের কাছে। মূলত তাদের উদ্যোগেই এই উৎসবটি আয়োজন করা সম্ভব হলো। অবশ্যই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সমগ্র গ্রামবাসী।