জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, গণপুর, পূর্ব বর্ধমান :- কালীমা কোনো গ্রামের ক্ষ্যাপাকালী, কোথাও ডাকাত কালী, শ্মশানকালী, কোথাও বা ছেলেকালী নামে পরিচিত। কোথাও গায়ের রঙ আকাশী তো কোথাও বা কালো । কালীর নামে কোনো কোনো গ্রামে পুকুরের নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছে। নাম বা গায়ের রঙ নিয়ে আছে আলাদা আলাদা জনশ্রুতি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে সেই লোক কাহিনী।
বহুদিন আগের ঘটনা। অন্যান্য দিনের মত মঙ্গলকোটের গণপুরের ভট্টাচার্য বাড়ির প্রবীণ সদস্য নিমাই ভট্টাচার্য নিজেদের পৈত্রিক পুকুর কালীসায়ের থেকে স্নান করে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন তার পিছনে পিছনে একটা এলোচুলের কালো কিশোরী মেয়ে আসছে। বাড়ির কাছেই সাঁওতাল পাড়া। পুকুরে স্নান করতে গেলেই ওখানকার ক্ষেপি মেয়েটা তার পিছনে পিছনে আসে এবং তাদের বাড়ি থেকে মুড়ি নিয়ে আবার চলে যায়। সুতরাং তিনি অন্য কিছু ভাবেননি, তিনি ভেবেছিলেন এবারও মেয়েটি মুড়ি নিতে আসছে। কিন্তু এবার যেটা ঘটল সেটা ছিল তার কল্পনার বাইরে।যে মুহূর্তে তিনি বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েছেন হঠাৎ শুনতে পেলেন – “আমাকে নিয়ে যাবিনা ?” চমকে ওঠেন নিমাই বাবু – মেয়েটা তো কোনোদিন তাকে এভাবে ডাকেনি? সেতো গুড়-মুড়ি নিয়েই চলে যায় । পিছনে তাকিয়ে সেই কিশোরী মেয়েটিকে আর দেখতে পাননি। তাহলে ডাকল কে? গভীর ভাবনায় পড়ে যান ধার্মিক মানুষ নিমাই বাবু। সেই রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখেন । মা’কালীর নির্দেশে শুরু হয় কালী পুজো। কথিত আছে সেই এলোচুলের মেয়েটিকে ক্ষেপির মত দেখতে লাগছিল তাই মায়ের নাম রাখা হয় ক্ষ্যাপাকালী। যেহেতু তার গায়ের রঙ ছিল কালো তাই মায়ের গায়ের রঙ করা হয় কালো। এসব প্রায় দেড়’শ বছর আগেকার ঘটনা।
স্বপ্নে পাওয়া মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী কালীসায়েরের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে গভীর রাতে পাটকাঠি জ্বালিয়ে মায়ের ঘট আনা শুরু হয়। আজও সেই রীতি চলে আসছে। শত পরিবর্তনেও সেই নিয়ম কিন্তু বজায় আছে। এখনো সেই নির্দিষ্ট জায়গায় মদের বোতল, কলকে, ত্রিশুল ইত্যাদি নাকি পাওয়া যায়। ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যদের বিশ্বাস স্বয়ং বাবা মহাদেব নাকি ওখানে বাস করেন। তাইতো বাবার প্রিয় জিনিসগুলো ওখানে পাওয়া যায়।
এখনো মায়ের ভোগের থালায় দেখা যায় আঁচড়ের দাগ। দেখলে মনে হবে কেউ যেন সেখান থেকে আঁচড় কেটে খাবার তুলে খেয়েছে। যতই গভীর রাত হোকনা কেন অত লোকের সামনে কে ভোগ তুলে খেলো সেটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এখনো ভেবে এই রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্য সহ উপস্থিত ব্যক্তিরা। তাদের স্থির বিশ্বাস সবার অলক্ষ্যে স্বয়ং ‘মা’ এসে ভোগ খেয়ে গেছেন ।
প্রথম থেকেই তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে মায়ের পুজো হতো। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে গ্রামের বাসিন্দা শ্যামাপদ মুখার্জ্জী জায়গাটি দান করেন। এখন সেখানেই গড়ে উঠেছে স্থায়ী কাঠামো। আছে পঞ্চমুণ্ডীর আসন। কর্মসূত্রে ভট্টাচার্য বাড়ির অধিকাংশ সদস্য বাইরে থাকলেও কালীপুজোর সময় ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এমনকি বিবাহিতা মেয়েরাও একই পথ অনুসরণ করে। তাদের বক্তব্য, ‘মায়ের টান তো আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।’
ভট্টাচার্য বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের গৃহবধূ পিয়ালী বললেন,’বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, মনে হয় ‘মা’ যেন তার সুরক্ষার বর্ম দিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছেন। ঠাকুরতলা দিয়ে গেলে একটা আলাদা অনুভূতি হয়।’ এই অনুভূতি শুধু ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যদের নয় গ্রামের আরও অনেকেই বিভিন্ন সময় অনুভব করে থাকেন। তাইতো শুভ কাজে যাওয়ার আগে তৃণা, ত্রিজিৎ, গার্গী সহ অন্যান্যরা মায়ের আশীর্বাদের পুষ্প সঙ্গে নিয়ে যেতে ভোলেনা।