জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরাঃ- অনেক দিন আগেকার কথা। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৯ টার ঘর ছুঁই ছুঁই। শুরু হয়ে গেল ব্যস্ততা। স্নান করে, খাওয়া দাওয়া সেরে, ধুতি-পাঞ্জাবী পড়ে, অনেকে অবশ্য তখন প্যাণ্ট-সার্টও পড়তেন, মানুষ তৈরির মন্দিরে প্রবেশ করবেন পুরোহিতরা। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যেতেন বিদ্যালয়ে। তারপর ঘণ্টা, প্রেয়ার লাইন, এক হাতে লাঠি ও অন্য হাতে হাজিরা খাতা নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতেন শ্রেণিকক্ষে। শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় নিয়ে চুপচাপ বসে থাকত শিক্ষার্থীরা। শুরু হতো পাঠদান। কচিকাচাদের দুষ্টুমি কখনো কড়া হাতে, কখনো বা স্নেহশীল পিতার অনুভূতি নিয়ে সামাল দিতেন। শিক্ষক দিবসের দিন থাকত অন্য পরিবেশ।
আজ সেই সব পরিবেশ থেকে ওরা অনেক দূরে। সরকারি নিয়ম মেনে কেউ দীর্ঘদিন আগে, কেউ বা সদ্য সেই মন্দির ছেড়ে চলে এসেছেন। ওরা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সহজ সরল ভাষায় প্রাক্তন। তাই আজ আর কেউ ওদের ডাকেনা, খোঁজও রাখেনা। শিক্ষক দিবস এলেই ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি তাঁদের হৃদয়ে বেদনার ছবি আঁকে এবং সেদিনের কথা ভেবে হয়তো বাড়ির কোনো নিভৃত কোণে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আসলে প্রাক্তনদের খোঁজ কেউ রাখেনা। বর্তমান যেখানে অবহেলিত সেখানে প্রাক্তনদের খোঁজ কে আর রাখে!
ওরা হয়তো জানতেন না কেউ কেউ আজও ওদের জন্য এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। তাইতো গুসকরা পুরসভার পক্ষ থেকে শিক্ষক দিবসের আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে ওরা চমকে ওঠেন। পুরসভার বর্তমান কাউন্সিলরদের একটা অংশ তাঁদের প্রাক্তন ছাত্র হলেও বর্তমান যান্ত্রিক যুগে কে আর ওদের অবদান মনে রাখে! এরা রেখেছে।
গুসকরা পুরসভার পক্ষ থেকে ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিন এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যথাযথ মর্যাদা সহকারে স্থানীয় প্রায় ৮০ জন প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। মাথায় ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদের আহ্বান করা হয়। পরে হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি করে গোলাপ ও তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একটি করে মানপত্র।
সম্মাননাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে চন্দ্রিমা , প্রত্যুষা , সৃজনী, প্রত্যুষা, সমৃদ্ধি, উদান্তিকা, পৌলীমাদের নৃত্য এবং অরিত্রি ও কস্তুরির সঙ্গীত উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে।
এর আগে যার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয় সেই সর্বপল্লী ডঃ রাধাকৃষ্ণানের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে তাঁর প্রতি সম্মাননা প্রদান করেন উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্মাননা পেয়ে বলরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশান্ত সাধু, মঞ্জুশ্রী আশ, গৌরী কর, সুব্রত ঘোষ, মুরাতি মোহন চৌধুরী, কল্পনা হাজরা প্রমুখ প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব খুশি। তাদের প্রতিটি অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ছিল খুশির রেশ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী, ভাইস চেয়ারম্যান বেলি বেগম সহ অন্যান্য কাউন্সিলররা এবং পুরসভার বেশ কয়েকজন কর্মী ও সাধারণ মানুষ। অস্থায়ী মঞ্চে উপবিষ্ট প্রবীণ শিক্ষকদের সামনে শান্ত ছাত্রের মত বসে ছিলেন চেয়ারম্যান সহ পুরসভার প্রশাসকরা- এই দৃশ্য অন্য মাত্রা এনে দেয়।
সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মধুসূদন পাল। তিনি অতীতের মত লাঠি বা বেত হাতে গুসকরা শহরের অতীত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উপস্থিত প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে আবেদন রাখেন।
বর্তমানে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে অতীতের নিকট সম্পর্কের পরিবর্তে দূরত্বের সম্পর্ক দেখে হতাশা ঝরে পড়ে সুশান্ত সাধুর কণ্ঠে। তিনি বললেন – সবার মধ্যে যেন একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের পক্ষে বড় বিপজ্জনক।
অন্যদিকে কুশল বাবু বললেন – কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, সবার মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা অতীতের সেই পরিবেশ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনতে পারব। তিনি এরজন্য অভিভাবকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।