সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- একবার একজন ভক্ত প্রশ্ন করেছিলেন,“ ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ কিভাবে করতে হয়? কয়েকবার চেষ্টা করেও পারি নি। ভয় হয় যদি তিনি সাহায্য না করেন শেষ পর্যন্ত?” স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ বলেছেন,“সব চেষ্টার পরই ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ সম্ভব। আমরা শর্ত রেখে সমর্পণ করি বলেই এটা সফল হয় না। বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দাবি করি, শর্ত রাখি, রিটার্ন আশা করি। এ সমর্পণ নয়। শিশু যখন মায়ের হাত ধরে হাঁটে, তখন সে মা’র উপর পুরো বিশ্বাস করে, নির্ভর করে। মা তাকে বাজারে নিয়ে যান কি মাসির কাছে, অথবা ক্রেশে রেখে অফিসে চলে যান, শিশু এ নিয়ে চিন্তা করে না। গিরিশ ঘোষের কিশোর সন্তান মৃত্যুশয্যায়। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছেন। স্বামীজি, রাজা মহারাজ, অন্যান্য গুরুভাইয়েরা দেখতে এসেছেন। অনেকেই চোখের জল মুছছেন, কিন্তু গিরিশ ঘোষ স্থির হয়ে দেখছেন নিজের ছেলেকে। স্বামীজি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন; জি.সি. এই দুঃখের সময় তোমার চোখে জল নেই কেন? গিরীশবাবু উত্তর দিলেনঃ যদি কাঁদতে পারতাম তবে বুকটা একটু হালকা হতো। কিন্তু আমি তো কাঁদতে পারব না, আমি যে ঠাকুরকে বকলমা দিয়েছি। তাঁকে সব দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি যা করেন তা-ই স্বীকার করে নিতে হবে। এই হলো ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ।”
গিরীশবাবু ভৈরবের অবতার ছিলেন। কিন্তু আমরা কিভাবে সমর্পণের সাধনা করতে পারি? মহারাজ বলেন, ” এর উত্তর দিয়েছেন ঠাকুরঃ ‘কৃ’ মানে কর, ‘পা’ মানে পাবি। তাঁর কথাকে কিভাবে রূপ দিতে পারি? রোজ কিছু সময় সমর্পণ অভ্যাস করে। কিভাবে?
রোজ সম্ভব না হলে সপ্তাহে ২ দিন, অন্তত একদিন একঘন্টা অভ্যাস করতে পারি। নিজের সুবিধামতো, কাজের সময়ে। নির্জনে বসে নয়। দিনের কাজ বা ডিউটি করে যাব নিষ্কামভাবে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, কাজের পরিণতি যাই হোক, সবই ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভেবে শান্ত মনে গ্রহণ করব হাসিমুখে। তিনি আমায় কোনদিকে নিয়ে যাবেন এ নিয়ে চিন্তা না করে মায়ের হাত ধরে রাখা শিশুর মতো থাকতে পারি? এভাবে শুরু করতে পারি? চেষ্টা করা যাক। সফল হই কি ব্যর্থ, ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করব। নিজের কোন ইচ্ছা বা প্রত্যাশা না রেখে তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার অনুশীলন করে যাব।
একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। নিজের আলস্যকে যেন সমর্পণের রঙ না দিই। সব চেষ্টার পরই সমর্পণ ভাব আসতে পারে। এজন্যই ঠাকুর বলেছিলেন “কৃ” কর, “পা” পাবি। নৌকো চালানোর দুই উপায় — দাঁড় বাওয়া ও পাল তোলা। প্রথমটি সংগ্রাম, দ্বিতীয়টি সমর্পণ। ঠাকুর কি বলছেন? “কৃপাবাতাস তো বইছেই, তুই পাল তুলে দেনা। আর পাল তুলতে নিজের চেষ্টা দরকার। অর্থাৎ রামকৃষ্ণ-নামের মাস্তুলে ঠিক বসে থাকার আগে পাখিকে চারদিক উড়ে আসতে হয় ডাঙার খোঁজে। কিছু মানুষ সমর্পণ করে আলস্য বশত। কেউ ভয়ে। কিন্তু প্রকৃত সমর্পণ সম্ভব হয় ভালবেসে। ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও বিশ্বাস তীব্র বা উচ্চ হলে তবেই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা যায়।”



















