সঙ্গীতা চৌধুরী: – ওস্তাদের মার শেষ রাতে আর শেষ রাতে বাজিমাত করতে আসছে ওস্তাদ- এই ওস্তাদ কে? তাই ভাবছেন তো ? এই ওস্তাদ আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হ্যাঁ,রবি, ইন্দ্র, নাথ ও ঠাকুর-এই চারটি আসলে আলাদা আলাদা চার চরিত্র, এই চরিত্র গুলোকে যখন দেখবেন তখন দুটো ভিন্ন আঙ্গিক খুঁজে পাবেন, যিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন তিনি খুঁজে পাবেন রবীন্দ্র চেতনা ও রবীন্দ্র জীবন দর্শন আর যিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন নি, তাদের কাছে এই চারটি চরিত্র এক নতুন দিগন্ত রূপে ধরা দেবে- আর এই চারটি চরিত্রকেই এক সুতোয় বেঁধে রাখবে ভানুসিংহ নামের একটি চরিত্র। এই ভানুসিংহ চরিত্রটি করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা কোলাজ সেনগুপ্ত। রাসবিহারী বসু, মিন্টুর পর রবীন্দ্রচেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি চরিত্র ভানু করে কেমন অভিজ্ঞতা হলো কোলাজের ? সেই নিয়েই দীর্ঘক্ষণ কথা হলো কোলাজের সাথে! মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে কী বললেন কোলাজ ?
১। ভানুসিংহ চরিত্রটি এক কথায় বলতে গেলে কেমন ?
কোলাজ : আমরা আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনে, অজস্র মানুষের সান্নিধ্যে আসি, তাদের কেউ আমাদের পরিচিত; বেশিরভাগই আমাদের অপরিচিত। বাসে আপনার পাশের সিটে যে মানুষটা বসেন, ৯৫% ক্ষেত্রেই সেই মানুষটি আপনার অপরিচিত। কানে হেডফোন থাকলে বা what’s app এ প্রেমিক/প্রেমিকা থাকলে, আপনি অধিকাংশ সময় তাকে খেয়ালই করবেন না। আপনি খেয়াল না করলেও, সেই মানুষটার নিজস্ব একটা গল্প আছে। সেই গল্পটা তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। সিনেমা তো আসলে কিছু মানুষের, কিছু মুহূর্তের সামগ্রিক সংমিশ্রণ। আমার ধারণা, এমন কোন চরিত্র নেই, যাকে নিয়ে সিনেমা করা যায় না, অথচ এমন প্রচুর চরিত্র আছে যাকে নিয়ে সিনেমা করা হয় না। এক কথায়, ভানু সেইরকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
২। আপনার করা রাসবিহারী মিন্টু প্রত্যেকটি ছবি সমাজের প্রতিচ্ছবি, ভানু ও কি তাই ?
কোলাজ : যে কোনো চরিত্রই সমাজ থেকে উঠে আসে। সুতরাং প্রতিটি চরিত্রই সমাজের প্রতিচ্ছবি বলা চলে। অবশ্য আমি মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির কথা বলছি না, যেখানে নির্দিষ্ট হিরো, হিরোইন এবং ভিলেন থাকে।
তবে খতিয়ে দেখলে, হিরো,হিরোইন বা ভিলেন প্রত্যেকেরই তো একটা সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে। ছবির ব্যবসায়িক স্বার্থে সেই প্রেক্ষাপটকেই একটু আধটু বাড়িয়ে কমিয়ে দেখানো হয়। সেই অর্থে ভানু সিংহ সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভানু সিংহের মতন চরিত্র আমাদের প্রত্যেকের পাড়ায় থাকে। লাল দা, নীল দা, বুলু দা, ইত্যাদি ইত্যাদি নামে আমরা তাকে ডাকি।
৩। ভানু চরিত্রটা বেছে নেওয়ার কারণ কি নিছকই কাজের অফার আসায় বেছে নেওয়া? না নতুন করে নিজেকে এক্সপ্লোর করা ?
কোলাজ : আমি সবসময় চেষ্টা করি পরপর যে চরিত্রে অভিনয় করবো, তা যেন একরকম না হয়ে যায়। জীবনে যদি আমি দশটা কাজও করি, দশটা দশ রকম চরিত্র করতে চাই। যে কোন চরিত্রের ক্ষেত্রেই নিজেকে এক্সপ্লোর করি।
৪। ভূতের রাজা যদি আপনাকে বর দেয় তাহলে রাসবিহারী, মিন্টু,ভানুর পর ঠিক কী ধরনের চরিত্রে ফিরে দর্শককে চমকে দিতে চাইবেন ?
কোলাজ : আমার কোনো ড্রিম ক্যারেক্টার নেই, আমাকে যে চরিত্র দেওয়া হয়, সেই চরিত্র নিয়েই আমি স্বপ্ন দেখি। অভিনয়ের সাথে সাথে আমি আরো অনেক কিছু করি। মার্শাল আর্টস, সাঁতার, পাহাড় চড়া ইত্যাদি।
আমি চাইবো অভিনেতা হিসেবে আমার প্রত্যেকটি প্রসপেক্ট নির্দেশকেরা এক্সপ্লোর করুন। অভিনেতা হিসেবে যতটুকু পোটেনশিয়াল আমার আছে, তার পুরোটা ওনারা ব্যবহার করুন। সেটা যদি একটাই ছবিতে/চরিত্রে সম্ভব না হয়, তাহলে আলাদা আলাদা ছবিতে বা চরিত্রে। অবশ্য ভুতের রাজার কাছে বর চাইলে আমি চাইবো, চরিত্র যেমনই হোক, অর্থনীতির লেনদেনটা যেন সঠিক সময়, সঠিকভাবে হয়। টাকার অংক কম বেশি হতে পারে, কমিটমেন্টটা যেন থাকে।
৫। দেবেশ রায় চৌধুরী অভিনয় জগতে আপনার গুরু সেখানে ভানু চরিত্রে সবথেকে বেশি স্ক্রিন শেয়ার দেবেশদার সাথে এই এক্সপেরিয়েন্সটা কীভাবে তুলে ধরবেন ?
কোলাজ : ২০১২ সালে আমি ওনার ছাত্র ছিলাম। নেহেরু চিলড্রেনস মিউজিয়ামে, অভিনয় শেখার সময় ওনার সাথে আলাপ। তখন প্রত্যেকদিন প্রায় তিনটে করে নাটক দেখছি। তখন স্কুলে পড়ি, স্বভাবতই অত টাকা থাকতো না। দেবেশ স্যার প্রথম মানুষ, যাকে গিয়ে আমি বলেছিলাম “আপনার এই নাটকটা দেখতে চাই, আমার কাছে পর্যাপ্ত পয়সা নেই। টিকিটটা একটু কম দামে অথবা কমপ্লিমেন্টারি কি হতে পারে?”
উনি সেদিন টিকিটের টাকা নেন নি। তারপর থেকে যখনই ওনার নাটক দেখেছি এবং উনি খেয়াল করেছেন,আমি এসেছি, কখনোই উনি আমাকে টিকিট কাটতে দেন নি। আমার কাছে টাকা থাকলেও উনি বলেছেন “রেখে দে, চানাচুর খাবি”-তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে আমার ঝুলিতে। ২০১২-১৩-১৪ ছাড়িয়ে ক্রমে ক্রমে এসেছে ২০২৪ সাল তো এখন যখন ‘ওস্তাদ’এর ভানুসিংহ চরিত্রটা করতে গিয়ে দেখি আমার প্রথম শট দেবেশ রায়চৌধুরীর সাথে,উনিই আমার সহ অভিনেতা, তখন সেই ভালোলাগার রেশটা ঠিক কথাই বলে বোঝানোর নয়, ছাত্র থেকে সহ অভিনেতা হয়ে ওঠার অনুভূতিটাই পর্বত সমান হয়ে ওঠে আর সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় নিজের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস রেখে আমি যে এই কাজ করে গিয়েছি , সেখানে কোনো ভুল ছিলো না। ১২টা বছরের অভিজ্ঞতা, সততা, কর্মোদ্যম, নাছোড়বান্দা মনোভাবের ফল কিছুটা হলেও পেয়েছি আর বাকিটা তোলা থাকলেও সময়ের খাতায়, বিশ্বাস রাখি অবশিষ্টটুকুও পেয়ে যাবো এভাবেই।