eaibanglai
Homeএই বাংলায়রাজু ঝা খুনে তদন্তের নজর কি এবার প্রভাবশালীদের দিকে ?

রাজু ঝা খুনে তদন্তের নজর কি এবার প্রভাবশালীদের দিকে ?

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- কোল মাফিয়া রাজু ঝা খুনের কিনারা দূরঅস্ত, বলিউডের ফিল্মি কায়দায় হাড় হিম করা এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের আসল কারণ নিয়ে ঘটনার ২৪ ঘন্টা পরও ধন্দে পুলিশ সহ পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের রাজনৈতিক মহল। একই ধন্দের ঘোরে রাজ্য রাজনীতি তো বটেই, রাজ্যের দুঁদে গোয়েন্দারাও। তবে, এরই মাঝে, যাকে বলে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ভর সন্ধ্যায় লোকারণ্যের মাঝে, জাতীয় সড়কের গায়ে কয়লা কারবারের ‘বেতাজ বাদশা’কে পরপর গুলিতে ঝাঁঝরা করার ‘দুঃসাহস’ যারা দেখালো তারা কি বেআইনি কয়লা কারবারেরই শরিক, নাকি তারা নিছক ভাড়াটে খুনি ? নাকি এর নেপথ্যে বাহুবলি রাজনৈতিক দাদাগিরির দাপট রয়েছে, তা নিয়ে যেমন অথৈ জলে শিল্পাঞ্চলের সাধারণ মানুষ, সম্ভবতঃ তেমনই দিশাহীন তদন্তকারী জেলা পুলিশ।

ঘটনার ২৪ ঘন্টা কেটে গেলেও কেন তদন্তের উল্লেখ যোগ্য অগ্রগতি হয়নি, তা নিয়ে নিহত কোল মাফিয়ার পরিবার, পরিজনদের পাশাপাশি প্রশ্ন তুলছেন শিল্পাঞ্চলের ওয়াকিবহাল মহলের একাংশও। তবে, তারা একথাও বলছেন-‘এটা কি স্রেফ বিনা মেঘেই বজ্রপাত ? নাকি বজ্রপাত ঘটানোর জন্য বাংলার পড়শি রাজ্যগুলি থেকে গত দু-তিন মাসে কিছু কালোমেঘ ভাড়া করে আনা হয়েছিল ?’ যদি তাই হয়, তবে সম্ভাব্য প্রশ্ন-কে বা কারা ভাড়া করলো এই বাজ পড়া মেঘ ? এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি রবিবার সন্ধ্যা অব্দি। তবে, এরই মাঝে বিজেপি নেতা এবং দুর্গাপুর (পশ্চিম)র বিধায়ক লক্ষণ ঘোড়ুই সরাসরি দাবি করেছেন, “রাজু ঝা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাকে বেশি করে টার্গেট করেছিল রাজ্যের শাসক দল। আমাদের দলে যোগ দেওয়ার বহু আগে থেকেই তাদেরই ছত্রছায়ায় থেকে কয়লার কারবার চালাচ্ছিল রাজু।” পাশাপাশি, তিনি এও দাবি করেন, “আমাদের দলে অনেকেই যেমন তদন্তের হাত থেকে বাঁচতে যোগ দিয়েছিল, রাজুও সেই রকমই একজন। সে কোনদিনই বিজেপিতে সেভাবে সক্রিয় ছিলনা।” রাজু যদি বিরোধী দলে গিয়ে ‘সেভাবে’ সক্রিয় নাই ছিলেন, তাহলে তাকে নিয়ে শাসকদলের মাথা ব্যাথাই বা থাকবে কেন ? তাহলে কি রাজু ঝা হত্যার নেপথ্যে রয়েছে শিল্পাঞ্চলের কয়লা কারবারিদের চিরাচরিত গ্যাংওয়ার ?

রাজ্যে পালা বদলের পর আসানসোল- দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠন করে কয়লা কারবারের খানিকটা হলেও রাশ টানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কারবার থেকে হাত গুটিয়ে বসে যান একসময় সিপিএমের ছত্রছায়ায় থাকা রাজু। তিনি মন দেন দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে তার বহু প্রতীক্ষিত তারকা হোটেল প্রকল্পে। কিন্তু, কমিশনারেট পুলিশেরই একটি বিশেষ সূত্র জানাচ্ছে, গত আট মাস যাবৎ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে রাজু পাণ্ডবেশ্বর, লাউদোহা ও রানীগঞ্জের কিছু এলাকায় সরকারি বৈধ কয়লার ডি.ও (ডেলিভারি অর্ডার) কে ঘিরে ফের নতুন করে কয়লা কারবার শুরু করেন। তার কিছু শাগরেদ ও তাদের নিয়োজিত মস্তান বাহিনী রাষ্ট্রায়ত্ব ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ডসের খনিগুলি থেকে বৈধ কয়লা পরিবহনের ওপর ‘ডান্ডা ট্যাক্স’ লাগু করে নতুন ধরনের কয়লা কারবার শুরু করে। যার নাটের গুরু নাকি ছিলেন এই রাজুই। বিষয়টি নিয়ে একটি অভিযোগও দায়ের করেন বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। তিনি আবার কেন্দ্রীয় কয়লা ও ইস্পাত বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। ওই অভিযোগে সৌমিত্র দাবি করেন, “রাষ্ট্রায়ত্ব খনিগুলি থেকে কয়লা পরিবহনের সময় টন পিছু ৬০০ টাকা করে গুন্ডা ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে। সবটাই হচ্ছে পুলিশ ও শাসকদলের নেতাদের একাংশের প্রত্যক্ষ মদতে।” সৌমিত্রর এই অভিযোগের তীর পরোক্ষে অবশ্য ছিল রাজু ঝা’র বিরুদ্ধেও। তার অভিযোগ কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক, কয়লা কাণ্ডে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাদের দফতরে পাঠান এই সাংসদ। তার অভিযোগের পাশাপাশি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও ‘ডান্ডা ট্যাক্স’ কারবারে জড়িত মাথা, রাজুর পাশাপাশি রানীগঞ্জের পাপ্পু, দুর্গাপুরের লোকেশ, বক্তারনগরের জয়দেব, বহুলার সামশের, নবগ্রামের মাজিরুল এবং আসানসোলের বার্নপুরের জাভেদের নাম উল্লেখ করে বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় ২০২২’র নভেম্বরে। তবে, তাতেও কারবারের বিশেষ কমতি হয়নি। প্রশ্ন-তাহলে কি এই ‘ডান্ডা ট্যাক্স’ই শেষে প্রাণ কাড়লো রাজুর? রাজুরই এক শাগরেদ পরিবহন ব্যবসায়ী লোকেশ সিং-এর স্থানীয় সিটি সেন্টারের কার্যালয়ে ভর সন্ধ্যায় দু’রাউন্ড গুলি চালিয়ে উধাও হয়ে যায় মোটরসাইকেলে চেপে আসা দুই দুষ্কৃতী গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। অল্পের জন্য রক্ষা পান লোকেশের ভাই রীতেশ সিং। ঘটনার পরপরই সেখানে পৌঁছে যান রাজুও। ঠিক এক মাস চার দিন পর আরেক সন্ধ্যায় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন সেই রাজু ঝা।

পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ের ল্যাংচা হবে শনিবার সন্ধ্যায় একটি নীল রঙের মারুতি ব্যালেনো গাড়িতে চেপে এসে দুই দুষ্কৃতী পর পর গুলি চালায় রাজুকে লক্ষ্য করে। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন রাজু ঝা। আহত হন তার সঙ্গী ব্রতীন মুখার্জী। গাড়ির চালক ও ব্রতীনকে কয়েক দফা জেরাও করেছে পুলিশ। ঘাঁটা হচ্ছে রাজুর মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস্। এরই মাঝে অবশ্য আততায়ীদের ব্যবহার করা নীল গাড়িটি পুলিশ উদ্ধার করে শক্তিগড় রেলস্টেশন সংলগ্ন রাস্তা থেকে। তাহলে, আততায়ীরা কোথায় গেল? তারা কি ট্রেন ব্যবহার করল, নাকি তাদের পিক আপ করার জন্য ছিল অন্য গাড়ী ? পুলিশ পরিত্যক্ত গাড়িটির ভেতর থেকে প্রচুর ভুয়ো নম্বর প্লেট ও মদের বোতল উদ্ধার করেছে। জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিষ সেন বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছে আততায়ীরা আসানসোলের দিক থেকে এসেছিল।”

প্রশ্ন আরো উঠছে, ব্রতিনকে প্রথম থেকেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হচ্ছে কেন ? এই ব্রতীনকে সঙ্গী করে কলকাতার দিকে ঠিক কোথায় যাচ্ছিলেন রাজু ? কেন যাচ্ছিলেন ? কার কাছে ? একটি সূত্র আবার জানাচ্ছে, ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ইডি’র দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল রাজুর। রাজু ঝা তো সেক্ষেত্রে সরাসরি দূর্গাপুর থেকেই দিল্লিগামী বিমান ধরতে পারতেন। তবে কি, কলকাতায় তার সঙ্গীর সাথে কোন এক আধিকারিকের গোপন বৈঠক করানোর কথা ছিল রাজুর ? যদিও, সরকারিভাবে এ বিষয়ে মুখ খোলেনি ইডি । ইডি’র দপ্তরে রাজুর যাবার নেপথ্যে নাকি প্রভাবশালীদের গচ্ছিত টাকা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদের প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে আসতো! এই প্রভাবশালীদেরই ‘তোলা আদায়ে’র দরুন পাওয়া কয়েক কোটি টাকা নাকি ১৭ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়া আসানসোলের হোটেল ব্যবসায়ী অরবিন্দ ভগতের কাছেও ভাড়া খাটাচ্ছিল ? প্রশ্ন-হাজিরার ডাক পড়লেই কেন বারে বারে দুনিয়া থেকেই ছুটি হয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের টাকা রাখা শিল্পাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ? তাই কি ? রবিবারই তদন্তে অগ্রগতি আনার জন্য জেলা পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি ‘সিট’ গঠন করেছে রাজ্য সরকার। রাখা হয়েছে দুজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কেও । রাজু খুনে তদন্তের নজর কি এবার সেই সব প্রভাবশালীদের দিকে ?

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments