eaibanglai
Homeএই বাংলায়লন্ডনের আগুন নিভলেও দুর্গাপুরে কবির হোটেল সেই 'জতুগৃহ'ই

লন্ডনের আগুন নিভলেও দুর্গাপুরে কবির হোটেল সেই ‘জতুগৃহ’ই

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: সময়মতো লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের ভয়াল আগুন থেকে রক্ষা পেলেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু, দুর্গাপুরে তার প্রিয় হোটেলটি আদতে যে একটি বিনা লাইসেন্সের ‘জতুগৃহ’, তার খোঁজ রাজ্য প্রশাসন রাখে কি? মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আদৌ হুঁশ আছে কি?

রাজ্যের মানব দরদী মুখ্যমন্ত্রীকে আগুনের মুখে ফেলে রাখতে এতোটুকুও কি বুক কাঁপেনা ‘প্রিয় ভাই’ কবি দত্তর? কারণ – যে ‘জতুগৃহ’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বারবার থাকার ব্যবস্থা করে দেন কবি, তার সেই বিলাসবহুল পেল্লাই হোটেলটি নাকি ১৫ বছর ধরে বিনা ফায়ার লাইসেন্সে চলেছে বুক ফুলিয়ে, প্রায় বিনা বাধায়।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন সময় দুর্গাপুরে এসে বারে বারে ওই হোটেলটিতেই ওঠেন। “ঐ কবি দত্ত মুখ্যমন্ত্রীর নাকি খুব পছন্দের একজন ব্যবসায়ী, তাই একের পর এক পদে উনি বসেছেন বিনা বাধায়। কার হিম্মত আছে উনার হোটেলের ফায়ার লাইসেন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার? তাই প্রশাসনও যেমন কোনোদিন রিপোর্ট চাইনি তেমনি আমরাও এনিয়ে চুপচাপই থেকে গিয়েছি,” বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক দুর্গাপুর অগ্নি নির্বাপন দপ্তরের অভিজ্ঞ এক আধিকারিক।

এ রাজ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে আবাসন এবং বহুতলে ফায়ার লাইসেন্স নেওয়াটা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি ৫০০০ স্কয়ার ফুটের বেশি বাণিজ্যিক এলাকা এবং দৈনিক ৫০ হাজার লিটারের বেশি জল ব্যবহার করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আবশ্যিক ভাবেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের থেকে সার্টিফিকেট নেওয়াটাও বাধ্যতামূলক। এগুলি সবই ১৯৫০ এর ওয়েস্ট বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস এক্ট এবং রাজ্য পরিবেশ দপ্তরের জন্য নির্দেশিত ১৯৮১ সালের বায়ু আইন ও ১৯৭৪ সালের জল আইনের বিভিন্ন ধারা মোতাবেক বাণিজ্যিক ভবনগুলির জন্য বাধ্যতামূলক শর্ত।

“না। ওই হোটেলটির চূড়ান্ত ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট এখনো অব্দি আমরা দিইনি। কারণ ওখানে একেক সময় একেক রকম ভাবে হোটেলে বিল্ডিংটি বিভিন্ন দিকে দৈর্ঘ্য প্রস্থ বার বার বাড়ানো হয়েছে,” বলে মন্তব্য অভিজ্ঞ ফায়ার অফিসার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের। তার মতে, “গোড়ায় অন্যান্য সকলের মতই ওনারাও আমাদের কাছে থেকে অগ্নি নিরাপত্তার রিকমেন্ডেশন বা লিখিত পরামর্শ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘন ঘন হোটেলটির আকার বদল হতে থাকায় তার দরুন যা যা নথিপত্র লাগে সেসব ২০২০ তে ওনাদের জমা করার পর একটি অংশের জন্য আমরা সার্টিফিকেট দিই। কিন্তু তারপরও ওনারা অন্যান্য অংশে নতুন করে নির্মাণ করেছেন যার দরুন ওই হোটেলটিতে চূড়ান্ত সার্টিফিকেট আমরা এখনও দিইনি। ওটাকে তাই আগুন সংক্রান্ত বিষয়ে আইন মোতাবেক পুরোদস্তুর নিরাপদ আমরা বলতে পারি না।”

তাহলে কি দাঁড়ালো?

আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান কবি দত্তর বিতর্কিত হোটেলটি তাহলে এত বছর ধরে সবার চোখে ধুলো দিয়ে আগুন নিয়ে কি জাষ্ট খেলছে? ওই হোটেলের মালিকের এতটাই প্রভাব আর দম্ভ যে প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চালিয়ে আসা পেল্লাই হোটেলটির জন্য তিনি সরকারি নিয়মকানুন, নীতির থোড়াই তোয়াক্কা করেন? কে তার টিকি ধরে টানবে? এডিডিএ’র এই নতুন বামুন নিজেই এখন লোকের টিকি-দাড়ি ধরে টান দিতে পারেন, কারণ তিনিই নাকি এখন বকলমে পশ্চিম বর্ধমান জেলার সর্বময় কর্তা। খোদ মুখ্যমন্ত্রী যাকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন প্রকাশ্য সভায় সেই কবির আবার অন্য কিসের সার্টিফিকেট লাগতে পারে – পরস্পর ঘটনা পরম্পরায় তা স্পষ্ট।

দুর্গাপুরের দমকল বিভাগের আধিকারিক সুদীপ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, “উনাদেরকে বেশ কিছু সংশোধনীর জন্য বলা হয়েছিল আর প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্টিফিকেট রিজেক্ট করা হয়েছিল। কিন্তু ওনারা আর সংশোধনী জমা দেন নি।”

কেন হোটেল কর্তৃপক্ষ এতটা উদাসীন? অথচ দুবছর আগেই কবির ওই হোটেলে ঘটলো একটি অগ্নিকান্ড। দমকলের আইনের ৩৫ ধারায় হোটেল কর্তৃপক্ষকে নোটিশও পাঠানো হলো দমকলের পক্ষ থেকে। কিন্তু তার পর?

“ওদের বয়েই গেছে। ওরা ওসবের কোন পরোয়াই করেনা। গত ১৫ বছরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অন্তত ১০ বার ওই হোটেলটিতে থেকেছেন আর প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা দেখেছেন কি স্বাচ্ছন্দে উনি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন হয়ে উঠেছেন। কার আর হিম্মত হবে এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার – তা সে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংক্রান্তই হোক না কেন!” – বলে থামলেন শহরের বিধাননগরের সমাজ কর্মী সুব্রত মল্লিক।

অন্যদিকে, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির এক স্থানীয় নেতা বললেন, “জমির বরাদ্দ থেকে শুরু করে বেআইনি নির্মাণ বিল্ডিং প্ল্যানে ফাঁকি, পুর করে ফাঁকিই হোক কি দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে ফাঁকি, আর এখন ধরা পড়ছে যে দমকল বিভাগকেও কাঁচা কলা দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোলের ছেলে সেজে বসে আছেন কবি দত্ত। মানতেই হবে খুবই উঁচু দরের খিলাড়ি উনি। বাম আমলে নেতা মন্ত্রীদের পেয়ারের লোক এখন টিএমসির। আর বিজেপি যদি কখনো আসে রাজ্যে তাহলে এই কবি তখন বিজেপির কোল আলো করে তৃণমূলকেই দাঁত দেখাবে – যার প্রমাণ গত ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন এক কর্নেলের ঘরে বসে কবি নিজেই রেখে এসেছিলেন, যা আমাদের অনেকেই সাক্ষী। ওতে কর্নেল ও খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।”

শরীরের ঢোকা ক্যান্সারের কোষের মত এ শহরের বুকে কবি দত্তর হোটেলটি বছরে বছরে নির্দ্বিধায় আড়ে বাহারে যেভাবে বাড়ছে, তাতে দমকল বিভাগের মতোই ধন্দে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদের দুর্গাপুরের আঞ্চলিক দফতরের পরিবেশ বাস্তুকার অরূপ দে স্পষ্ট জানালেন, “পরিবেশ সংক্রান্ত জল আইন আর বায়ু আইনের বিভিন্ন ধারায় বাণিজ্যিক কেন্দ্রে হোটেলগুলির আমাদের দপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, জল ব্যবহারের পরিমাণ এবং ব্যবহৃত বাণিজ্যিক এলাকার আয়তনের উপর সবটাই নির্ভর করে।” জল আইনের ২৫ এবং ২৬ নম্বর ধারা এবং বায়ু আইনের ২১ নম্বর ধারা এইসব হোটেলের জন্য প্রযোজ্য। শহরের সিটি সেন্টারে কবি দত্তর সিটি রেসিডেন্সি হোটেলের ব্যাপারে তাহলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কি তবে ঢালাও ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে?

না। বরং বলা যায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদই সেই ১৯৯৭ সালের ‘আই ৯৫৮ প্লট’, ২০০৩ সালের ‘আই ১৯৫১’, ২০০৪ সালের ‘আই ২৯৫৬’ বা ২০০৮ এর ‘আই ৫৪২’ প্লটগুলির দরুন কবি দপ্তর বিতর্কিত ওই হোটেলটিকে আজও কোন ঢালাও ছাড়পত্র দেয়নি বলে অভিযোগ। “আসলে পর্ষদ দেয়নি নয়, কবি দত্তর হোটেল কর্তৃপক্ষ ওসব আর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি নিশ্চয়ই। ওসব কে ওনারা অত পাত্তা দেন না,” বলে দাবি সমাজকর্মী সুব্রত মল্লিকের। সুব্রতই সম্প্রতি কবি’র বিতর্কিত ওই হোটেলটি নিয়ে তথ্য জানার অধিকার আইন মোতাবেক একটি পিটিশন দাখিল করে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কবি দত্তর হোটেলকে বিভিন্ন দফায় আলাদা নিকাশী নালার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয় এবং ক্ষতিকর বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য আলাদা করে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেয়। “তার সবটি কি কবি মেনেছেন? মানলে তো বাকি প্লটগুলোর জন্য সার্টিফিকেট নিতে ওনার কোন অসুবিধাই হতো না,” বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক দুর্গাপুর দূষণ পর্ষদের এক আধিকারিক। তার কথায়, “ওখানে নিয়মমাফিক কোন কিছুরই খোঁজ করতে যাওয়াটাও ভীষণ রিস্কের। অনেক উঁচু তলায় ওনার ব্যাপার-স্যাপার। কোথা থেকে এখন কি হয়ে যাবে কে জানে?” তার মতোই সমাজ কর্মী সুব্রত মল্লিকও বলেন, “ওনার হোটেলের ব্যাপারে পরিবেশ নিয়ে যেমন উনি বে-ফিকির, তেমনি রাস্তা চওড়া করার নামে বেআইনি নির্মাণ বাঁচিয়ে শহরের প্রাচীন গাছপালা উপড়ে ফেলায় তার কোনোই অনুতাপ নেই। নেই সবুজ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও। কারণ, এতগুলি গাছ কেটে দিলেন, কিন্তু আইন অনুযায়ী কোথায় কোথায় তার বদলে গাছ বসালেন সেসবের জিপিএস ট্যাগিং কই? তার জমানায় ওসব নিয়ে কিছুই বলতে চায়না ওনার আড্ডা।”

এতোসব অভিযোগ, অথচ ‘এই বাংলায়’ ডট কম কবির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “কোনো জবাব দেওয়া হবে না।”

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments