সঙ্গীতা চ্যাটার্জীঃ- বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা কোলাজ সেনগুপ্তর সাথে কথা হচ্ছিল আর জি কর কাণ্ড ও তিলোত্তমার বিষয় নিয়ে। অভিনেতা বললেন নিজের ভাবনার কথা। একই সাথে তিনি মনে করেন মিছিলে পা মেলানোর সাথে সাথে প্রত্যেকটি মানুষের নিজের দিক থেকে কিছু করা উচিত, সমাজ বদলের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, অভিনেতা নিজের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই সেই পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছেন।
অভিনেতা কোলাজ সেনগুপ্ত এই তিলোত্তমা ও আর জি কর প্রসঙ্গে বলেন,“ছোটবেলায় যখন আমার শহরের রচনা লিখতে হত স্কুলে, একটা লাইন আমরা অনেকেই লিখেছি; আমার শহর, কল্লোলিনী তিলোত্তমা…তিলোত্তমা। তিল তিল করে সৌন্দর্য সঞ্চারিত হয় যে নারীর মধ্যে। সৌন্দর্য্য কী? কাকে বলে? তার কতটা চোখে ধরা পড়ে? কতটা বাহ্যিক? এইসব লাইন লিখে বাংলা রচনায় নম্বর পেয়েছি। কিন্তু আজ এই নামটা শুনলেই সব ঘেঁটে যায়; ওলটপালট হয়ে যায়! লিখতে পারিনা। শুকিয়ে যায় কলমের কালি। লজ্জায়, ঘেন্নায় আর ভয়ে! গত প্রায় ১ মাস ধরে মানুষকে তাড়া করে বেড়িয়েছে এই নাম, রাত্রে ঘুমাতে দেয়নি। মুখের গ্রাস হাতেই থেকে গেছে।
আমরা ২/৪/৬ লাইন লিখে, নিজেদের অত্যন্ত সহমর্মী ভাবতেই পারি। ভাবতে পারি যে আমার অংশটুকু আমি করলাম, নির্দ্বিধায়! কিন্তু আমার অংশ ঠিক কতটুকু? আমি ৫টা লাইন লিখলাম আর এবং একটি তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করলাম এই ঘটনার। ঠিক সেইদিন সন্ধ্যেবেলায়, এমন বন্ধুবৃত্তে নিজেকে সঁপে দিলাম, যেখানে অহরহ চলে সেক্সিস্ট জোকস্, জেন্ডার বায়েসড চটুলতা, মস্করা…মানুষ হিসেবে কোথায় দাঁড়ালাম তবে? জানি এখন এসব তত্ত্বকথার সময় নয়। মানুষ প্রশ্ন করবেন, আপনার ইন্টারভিউটা পড়ে কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে? না। কিচ্ছু ঠিক হবে না। মেয়েটির মা-বাবার সামনে, যদি কখনো কালের নিয়মে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, আমি চোখ মেলাতে পারব না। আমরা আসলে খুবই অসহায়। ভয় আমাদের চালিকাশক্তি। সংবেদনশীল মানুষ হয়ে ওঠার পথে আমাদের ভয় আমাদের অন্তরায়। ভয় আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী! আমার দেখে সত্যিই ভালো লাগছে যে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ক্ষেত্রে পথে নামছেন! যদিও যারা পথে নামছেন, তাদের ফিল্টার করলে দেখা যাবে, সর্ষের মধ্যেই ভূত! তবে এই ঐক্য প্রয়োজনীয়। সংঘবদ্ধ মানুষকে রাষ্ট্র ভাঙতে পারে না। উল্টে, ভেঙ্গে পড়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা। হ্যাঁ, আমি মনে করি এই ঘটনা অরাজনৈতিক নয়। রাজনীতির সাথে এর যোগাযোগ ওতপ্রোত! পৃথিবীতে অরাজনৈতিক বলে কিচ্ছু নেই। কাজকর্মের ক্ষেত্রে বলি, কাজ আমি করছি। শ্যুটিং হোক বা নিজের ব্যবসা, দুদিকেই মন দিচ্ছি। মনটা ভারী হয়ে আছে, অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু কাজ মানুষের ধর্ম। করতেই হবে। আমি এই ঘটনার পরে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আমি অভিনেতা হওয়ার আগেও একজন মার্শাল আর্টিস্ট, স্পোটসম্যান। আমার সাথে কিছু প্রভাবশালী মানুষের যোগাযোগ হয়েছে ইদানীং। নাম বলছিনা। তাঁদের কর্মক্ষেত্রউল্লেখ করছি না। তাঁরা প্রত্যেকেই খুব সংবেদনশীল, সহমর্মী এবং চমৎকার মানুষ। আমি তাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে মেয়েদের আত্মরক্ষার ক্লাস করাবো। নিঃশুল্ক। আমার যতোটুকু আছে, আমি তার পুরোটা দিয়ে লড়াই করব এই ঘুণ ধরে যাওয়া ব্যবস্থার বিপক্ষে। কেউ প্রয়োজন বোধ করলে আমার সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তিগত স্তরেও যোগাযোগ করতে পারে। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সমাজে সুস্থ ভাবে বিচরণ করতে গেলে মেয়েদের মার্শাল আর্টস কেন শিখতে হবে? শিখতে হবে তার কারণ একটাই। আমি, আপনি যতই তত্ত্ব আওড়াই না কেন, গ্রাউন্ড লেভেল রিয়েলিটিটা একদম আলাদা। এমন পরিস্থিতি সৃষ্ট না হলেই ভালো হতো, কিন্তু হচ্ছে। যা হওয়া উচিত আর যা হয় তার মধ্যে বিস্তর ফারাক! আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না আমরা আসলে এখন একটি যুদ্ধে নেমেছি। যুদ্ধ করতে গেলে প্রতিপক্ষের প্রতিটি আঘাতের জবাবে পাল্টা আঘাত দিতে হবে! যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা রচনা লেখার সময় নির্দ্বিধায়, বিনা সংকোচে “কল্লোলিনী তিলোত্তমা” শব্দবন্ধটি লিখতে পারে।”