স্টাফ রিপোর্টার, দুর্গাপুর:- ‘আকাশ’ থেকে হুড়মুড় করে আস্ত লিফ্টটাই ভেঙে পড়ল সরকারি শপিংমলে। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও কাঁচের কেসিং-এর ভেতর যেমন মুখ থুবড়েই পড়ে রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা দামি সেই লিফ্ট, বিষয়টি সামাল দিতে গিয়ে ঠিক তেমনই মুখ থুবড়ে পড়েছে দুর্গাপুর নগর নিগমের পরিচালন ব্যবস্থা। বুধবার দুপুরে নগর নিগমের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তা বলেন, “আমরা বুঝে উঠতে পারছি না- কি করে এটা হল আর কি করেই বা স্বাভাবিক করা যাবে সবকিছু!”
ভাবা যায়! মাথার ওপর আস্ত লিফ্ট ভেঙ্গে পড়ার ৪৮ ঘন্টা পরও নগর নিগম ঠাহরই করে উঠতে পারছে না- কি করা যায়! নগর নিগমের ভারপ্রাপ্ত বাস্তুকার মোহনলাল মাজি দায়সারা ভাবে বলেন, “লিফ্ট ভেঙে পড়ার ঘটনার পর আমরা লোক পাঠিয়েছি। এবার দেখা যাক কি করা যায়!” যে মাজির দ্রুত ঘটনাস্থলে সশরীরে ছুটে যাওয়ার কথা, তিনি দুজন লোক পাঠিয়ে নাকে তেল দিয়ে যেন শীতঘুমে। “আসলে অবসরপ্রাপ্ত এইসব উটকো লোকেরা একে তাকে ধরে নগর নিগমের বিভিন্ন জায়গায় দেদার ছড়ি ঘোরাচ্ছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ঠিক না থাকলে যেমন মাঝদরিয়ায় দিশাহীন ভেসে বেড়ায়, এই নগর নিগমের কার্যতঃ দশা তেমনটাই,” বলে আক্ষেপ নগর নিগমের সদ্য বিদায়ী বোর্ডের এক বরিষ্ঠ সদস্যের। তিনি আরো বলেন, “নগর নিগমের পাশের বিল্ডিংটাই ওই শপিংমল, আর মাজির মতো দায়িত্বপ্রাপ্তদের সেখানেও দু-পা হেঁটে তদারকি করার ফুরসত হলো না? কাকে আর কি বলবো?”
শহরবাসী তো বটেই, সম্ভবতঃ নগর নিগমেরও ‘সৌভাগ্য’ যে এতবড় দুর্ঘটনায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। “কারো কিছু হয়নি, কারণ ভেঙে পড়া এই ক্যাপসুল লিফ্টটা তখন ফাঁকা অবস্থায় তিনতলায় দাঁড়িয়েছিল। কোন প্যাসেঞ্জারই ছিলনা,” বললেন শপিংমলের এক নিরাপত্তারক্ষী।
প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে সিটিসেন্টারে নগর নিগম ভবনের পাশেই গড়ে ওঠে ‘সুহট্ট’ নামের ওই সরকারি শপিংমল। গত ২০০৭ সালের ৭ মার্চ সেটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য। এই শপিংমলেই শিল্পাঞ্চলের প্রথম কাঁচের কেসিং-এ মোড়া ক্যাপসুল লিফ্টটি বসানো হয়।
২০১২ সালে বাম বোর্ড বিদায় নেওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে জৌলুস হারায় সুহট্ট। শপিং মলটির পরিচালন ব্যবস্থারও আসে বিস্তর পরিবর্তন। ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয় ‘সুহট্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’। ফলে, মলটির নিয়মিত দেখভাল করার দায় বর্তায় নগর নিগমের আধিকারিক ও কর্মচারীদের ওপর। শুধুমাত্র কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীর হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয় আস্ত সুহট্টর দেখভালের ভার।
“প্রত্যেক মাসে মোটা টাকা মেনটেনান্স চার্জ নেয় নগর নিগম। তারপরও কি করে লিফ্ট ভেঙে পড়ে? আমাদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা কিসে ব্যবহার হয়?”-প্রশ্ন সুহট্টর বিভিন্ন স্টল মালিকের।
সোমবার বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আচমকাই লিফ্টটি ছ’তলা মলের ত্রিতল থেকে তার ছিঁড়ে সটান নিচে পড়ে। মলটির দোকান, শো-রুমগুলি একে একে বিদায় নিলেও, সেখানে এখন মূলতঃ বিভিন্ন বেসরকারি অফিস, ব্যাংক রয়েছে। যে সময় লিফ্টটি ভেঙে পড়ে, প্রায় তখনই পাঁচ তলা, চার তলা ও তিন তলার বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের ছুটির সময়। চার তলার একটি আর্কিটেক্ট অফিসের এক কর্মী বলেন, “বরাত জোরে বেঁচে গেছি। আমি লিফ্টের দিকেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ বোমা ফাটার মতো ভয়ংকর শব্দ হলো। চমকে উঠে দেখি লিফ্টটাই তার ছিঁড়ে সোজা নিচে পড়ে গেল।”
সুহট্টর ওই লিফ্টটির সর্বশেষ ফিটনেস্ পরীক্ষা ঠিক কবে হয়েছিল ? লিফ্টের অনুমোদন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২০২০ সালে রাজ্য সরকারের “পশ্চিমবঙ্গ লিফ্ট, এসক্যালেটর ও ট্রাভেল্টার নীতি” লাগু হয়েছে, যার প্রথম অধ্যায়ের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে লিফ্টের তার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত নিরীক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ওই ‘রুল’র ৬(১) ধারা মোতাবেক প্রতিবছর লিফ্টের জন্য প্রদত্ত লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করার কথা। সুহট্টের দুর্ঘটনাগ্রস্ত লিফ্টটির লাইসেন্সের বৈধতা আদৌ ছিল তো?- এ প্রশ্নের উত্তরে মাজি বলেন, “আমার ঠিক জানা নেই। ফাইলপত্র ঘাঁটতে হবে।”