সঙ্গীতা চ্যাটার্জী (চৌধুরী)ঃ- বন্ধুরা আজ রথযাত্রার দিন আপনাদের শোনাবো কেন জগন্নাথের ভোগে নিম পাতা বাটা দেওয়া হয়। আসলে এক সময় পুরীধামে লাণ্ডিমাতা নামে একজন বৃদ্ধা থাকতেন, তিনি ছিলেন বাৎসল্য রসে ভরপুর এক ভক্ত, সেই কারণে তিনি জগন্নাথ দেবকে নিজের সন্তান ভাবতেন ও একজন মা যেভাবে সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন হন তিনিও সেই ভাবে জগন্নাথের স্বাস্থ্য চিন্তায় উদ্বিগ্ন হতেন।তিনি চিন্তা করতেন, জগন্নাথ তো প্রতিদিন ষাট বার ভোজন করেন, যার মধ্যে থাকে ছাপ্পান্ন রকমের অন্ন ব্যাঞ্জন, কতরকমের মিষ্টি, কত রকমের ঘি। তিনি অবশ্যই এত ধরণের গুরুপাক, জমকালো খাবার দাবার ভোজন করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, এবং তার হয়তো কিছু পেটের সমস্যা হয়েছে। সেই জন্য যদি কিছু নিমপাতা বাটা খান তাহলে তার পক্ষে তা খুবই ভালো হবে। এইরকম মনোভাব নিয়ে লাণ্ডিমাতা প্রতিদিন মন্দিরে যেতেন তার পুত্রকে নিমপাতা বাটা খাওয়াতে।
একদিন নিমপাতা বাটার পাত্রটি নিয়ে লাণ্ডিমাতা মন্দির প্রবেশ দ্বারে গেলেন আর সেই সময় মন্দির কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী তাকে থামিয়ে বললেন, ও হে বৃদ্ধা! এই পাত্রে তুমি কি নিয়ে যাচ্ছো? লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, আমি আমার পুত্রের জন্য কিছু নিমপাতা বাটা নিয়ে যাচ্ছি। রক্ষী বলল, তোমার পুত্র কি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে? লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, আমার পুত্র রত্নসিংহাসনে বসে আছে, তার আখিঁ দুটি বিশাল সে আমার এই নিমপাতার তৈরী পদটি ভোজন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাকে ভিতরে যেতে দাও।
রক্ষী লান্ডিমাতার বাৎসল্য পূর্বক স্নেহ রস বুঝতে পারলেন না তিনি রেগে গিয়ে মাতাকে বললেন, তুমি কি বলছো? জগন্নাথ তোমার ছেলে? প্রভু জগন্নাথদেবকে কত ধরণের অন্নব্যাঞ্জন নিবেদন করা হয়। সেই সব ভোজন করে তিনি তৃপ্ত নন? তিনি কেবল তোমার ওই নিমপাতা বাটা ভোজনের জন্য অপেক্ষা করছেন? নিরাপত্তারক্ষী লাণ্ডিমাতাকে মন্দিরের মধ্যে যেতে দিলেন না।
মনে কষ্ট নিয়ে এরপর লাণ্ডিমাতা তার ঘরে ফিরে এলেন কিন্তু সারাদিন তিনি জগন্নাথের কথাই ভাবতে লাগলেন, তার মনে হতে লাগলো, আমার ছেলে নিশ্চয়ই আমার এই নিমপাতার জন্য অপেক্ষা করে আছে, এমন ভাবতে ভাবতে একসময় তিনি কাঁদতে থাকেন। শ্রী জগন্নাথদেব লাণ্ডিমাতার অন্তরের ভাব উপলব্ধি করেন এবং তার সঙ্গে বাৎসল্য রস উপভোগ করার জন্য তিনি সেই রাত্রে তার ঘরে আবির্ভূত হন, তখন হঠাৎই লান্ডিমাতার পুরো ঘর এক উজ্জল আলোয় ভরে ওঠে এবং তিনি সবিস্ময়ে দেখেন যে, তার প্রিয় পুত্র জগন্নাথ তার সমানে
শুষ্ক ও বিষাদগ্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে।
জগন্নাথ বললেন, মা আজ কত রকমের মিষ্টদ্রব্য ভোজন করেছি। আমার পেটে কষ্ট হচ্ছে, তুমি কি আমাকে কিছু নিমপাতা বাটা দেবে? লাণ্ডিমাতা তাড়াতাড়ি উঠৈ পড়লেন এবং উত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই জগন্নাথদেব তার গৃহ হতে অন্তঃহিত হলেন। সেই রাতে প্রভু শ্রীজগন্নাথদেব পুরীর রাজার কাছে স্বপ্নে আর্বিভূত হলেন এবং তাকে বললেন,“ রাজা! লাণ্ডিমাতা আমাকে তার পুত্র হিসাবে স্নেহ করেন। তিনি আমার মা, আর প্রতিদিন তিনি আমার জন্য অত্যন্ত প্রীতিসহকারে নিমপাতা বাটা নিয়ে আসেন। তোমার নিরাপত্তারক্ষী তাকে প্রবেশেদ্বারে থামিয়েছে এবং তার হাত থেকে নিমপাতা বাটার পাত্রটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তার তৈরী নিমপাতা বাটা খেতে আমি খুবই ভালোবাসি। আগামীকাল খুব ভোরে অবশ্যই তুমি তার কাছে যাবে এবং তাকে বলবে, সে যেন আমাকে ভোজন করাবার জন্য নিমপাতা বাটা নিয়ে আসে।”
স্বয়ং জগতের নাথের কাছ থেকে এই দিব্যাদেশ পেয়ে পরদিন খুব ভোরে উঠেই রাজা তার মন্ত্রীদের সাথে করে জগন্নাথ মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত লাণ্ডিমাতার ছোটো ঘরে গেলেন, লান্ডি মাতা তার কুটিরে রাজাও মন্ত্রীদের দেখে খুব অবাক হলেন। রাজা মাতাকে বললেন,“ হে মাতা ! মন্দিরের পাহারাদার রক্ষী আপনার প্রতি এক মহা অপরাধ করেছে। আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনার হাতে তৈরী নিমপাতা বাটা শ্রীজগন্নাথদেবের খুবই পছন্দ। আপনি শ্রীজগন্নাথদেবের একজন মহান ভক্ত এবং আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবতী যে তিনি আপনার বাৎসল্যপ্রীতির ভাবটি গ্রহণ করেছেন এবং আপনাকে তিনি নিজে মাতা জ্ঞান করেন। আজ থেকে আপনার কুটীরটি লাণ্ডিমাতা মঠ নামে প্রসিদ্ধ হবে। এই স্থানটি একটি পবিত্র তীর্থ হিসাবে বিবেচিত হবে। এই পৃথিবীতে আপনি যতদিন থাকবেন, প্রতিদিন আপনি শ্রীজগন্নাথদেবক নিমপাতা বাটা খাওয়াবেন। এমনকি আপনি দেহত্যাগ করার পরেও আপনার স্মৃতিতে শ্রীজগন্নাথদেবকে এই পদটি নিবেদন করা হবে।” রাজার কাছ থেকে এইরকম প্রীতিপূর্ণ কথা শুনে লাণ্ডিমাতা তার সৌভাগ্যের কথা ভেবে খুব খুশি হন, বর্তমানে লান্ডিমাতার স্মরণে নিমপাতা বাটার পরিবর্তে জগন্নাথদেবকে ছাপ্পান্ন ব্যাঞ্জনপদ ভোজন করার পর তিতোভোগ নামে একটি পদ ভোজন করানো হয় এবং তারপর মিঠিজল বা মিষ্টি জল নিবেদন করা হয়।