eaibanglai
Homeএই বাংলায়নরেন, বিধানের মস্তানিঃ বিরক্ত মমতা ধমকে দিলেন সবার সামনে

নরেন, বিধানের মস্তানিঃ বিরক্ত মমতা ধমকে দিলেন সবার সামনে

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- কি লাল পতাকার সেই দোর্দণ্ড প্রতাপের মাটিতে, কি তার নিজের রাজত্বের মনোরম সবুজ গালিচায় – ‘রাফ এন্ড টাফ’ তৃণামূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বারে বারে বুঝিয়েছেন – তিনি অন্য কারো মস্তানি সহ্য করেন না। সোমবার রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শুরুর দিনে তার সেই চেনা মেজাজে আড়ালে লুকিয়ে নয়, সকলের সামনেই এই ‘মস্তানি ইস্যু’তে এদিন ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিলেন রাজ্যের দুই বিধায়ককে।

পশ্চিম বর্ধমান জেলা থেকে ২০২১ এর ভোটে ওই দুই বিধায়কই তৃণমুল কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছেন, আর এখন বাড়তি দায়িত্ব সামলাচ্ছেন – একজন দলের জেলা সভাপতির, আরেকজন আসানসোলের মহানাগরিকের। বাজেট অধিবেশন সূচনার দিন সকলের সামনেই দলনেত্রীর কাছে আচমকা এমন ঝাড় খেয়ে তাদের ভেতর যে উথালপাথাল করা ঝড় বয়ে গেলো কয়েকটা মিনিটে, তার ছাপ পড়ে গেছে তাদের চোখেমুখে, চাপ বেড়েছে তাদের মনের ওপর।

কিন্তু, সোমবার ঠিক কি ঘটেছিল বিধানসভায়, কেনো নেত্রীর কাছে ঝাড় খেলেন দুই বিধায়ক, এই ঝাড় খেয়েও কি তারা আগামী দিনে টিএমসির সাথেই থাকবেন, নাকি এবার তারা অন্য দরজায় কড়া নাড়বেন – লাঞ্ছিত নেতাদের ঘিরে এই প্রশ্নই বেদম ঘুরপাক খাচ্ছে শিল্পাঞ্চল জুড়ে। কারণ, এদেরই একজন গত বিধানসভা নির্বাচনের মুখে মমতার পার্টি ছেড়ে নরেন্দ্র মোদির কোলে চাপার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, বলেও গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।

সোমবার শাসক তৃণমুল কংগ্রেসের বিধায়কদের নিয়ে বিধানসভার নৌসার আলি কক্ষে পরিষদীয় বৈঠকে বসেন দলনেত্রী মমতা। সেখানেই তিনি বেবাগা নেতা মদন মিত্রকে সচেতন করার পাশাপাশি, পান্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং বারাবনীর বিধায়ক বিধান উপাধ্যায়ের ওপর চড়াও হয়ে সকলের সামনেই বুঝিয়ে দেন – তিনি এই দুই নেতার সাম্প্রতিক কালের আচরণ, কাজকর্মের ওপর আসলে ঠিক কতটা বিরক্ত! দলের একাধিক বিধায়ক, নেতা সূত্রে জানা গেছে, নেত্রী নরেন্দ্রনাথকে উদ্যেশ্য করে নাকি বলেন, – ‘খুব মস্তান হয়েছো ? খবর রাখো তোমার সম্পর্কে তোমার চারপাশের লোকেরা কিসব বলে?’ বিধানকে সতর্ক করে বলেন, ‘তুমি নিজেকে সংযত করো। নরেনের সাথে ঝগড়া মিটিয়ে নাও।’ অল্প কয়েকদিন আগেই, দলের জেলা মিটিংয়ে উদ্ধত বিধান সকলের সামনেই দলের জেলা সভাপতির সামনে হুশিয়ারি দিয়ে বুঝিয়ে দেন – বারাবনীতে তার সাথে পাঙ্গা নিতে গেলে মুস্কিল হবে। এসব রিপোর্টই দুই নেতার অজান্তে পৌঁছে গেছে নেত্রীর টেবিলে – যা তাদের কাল হলো। আসলে, এদিন নেত্রী ঝেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন – কোনো বেয়াড়া, বেবাগা, অকেজো ল্যাম্পপোস্টের ভার তিনি ২০২৬ এর ভোটে আর বইবেন না, দরকার হলে ওই ল্যাম্পপোস্ট বদলে নতুন আলোর পথ তৈরি করে নেবেন। কারণ, ২০২৬ এর ভোটে ভেতরের সব অন্ধকার মুছে ফেলতে না পারলে এবার সত্যিই আঁধার দেখবে তৃণমুল কংগ্রেস – বলে মত রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের এবং দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের। তাই, ঘর গোছাতে এবার বেশ কিছু রদবদল করবে তৃণমুল কংগ্রেস, যার আঁচ নাকি মিলবে ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই। দলনেত্রী ১৫ দিনের মধ্যে নেতাদের একটি খসড়া রিপোর্ট তৈরী করার নির্দেশও দিয়েছেন।

এদিকে, সোমবার বার বারের চেষ্টাতেও কোনও প্রতিক্রিয়া না দিলেও, ‘মস্তানি ‘ প্রসঙ্গে বেজায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ নরেন্দ্রনাথ মঙ্গলবার সকালে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন দলনেত্রী এরকম কোনো শব্দবন্ধই ব্যবহার করেননি। তিনি রাগত স্বরে বলেন, “এসব বানানো কথা। দিদি আমাকে বা অন্য কাউকেই এরকম কিছুই বলেননি। এসবই মনে হচ্ছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বানানো। এটা আমার ভালো লাগলো না।” তবে, বাকি উঠে আসা প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ আর কিছু বলতে চাননি। তার ঘনিষ্ঠদের দাবি, “কেউ কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কান ভাঙানির জন্য এসব রটিয়ে বেড়াচ্ছে হয়তো!”

গত কয়েক মাস ধরে এ জেলায় শাসক দলের অভ্যন্তরে বেজায় অশান্তি চলছে, যার ছিটেফোঁটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল শ্রমিক সংগঠন, ব্লক নেতা নির্বাচন থেকে শুরু করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবিত পূর নিগমের প্রসাশক মনোনয়নকে ঘিরে, আর তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত দুর্গাপুর উৎসবকে ঘিরে। আবার ওই উৎসবের পাল্টা একটি স্পোর্টস কার্নিভাল হওয়ার পর আরো স্পষ্ট বোঝা যায় – এ জেলায় দল পুরোপুরি আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে। কিছু কিছু নেতা , বেওসায়ীর পুরোনো ‘ইয়ার দোস্তি’র মাঝে উঠেগেছে অদৃশ্য খাড়া দেয়াল। এসবের নেপথ্যে ভিন দল থেকে উড়ে আসা এক ‘পরিযায়ী মাতব্বর’, আর ‘দলের কেউ নই’ অথচ সর্বঘাটের কাঁঠালী কলা সেজে ছড়ি ঘোরানো এক ‘ন্যাকা চৈতনে’র উদ্ধত বাড়বাড়ন্তকেই দায়ী মনে করছেন কিছু ‘নিবেদিত প্রাণ’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভক্ত। তাদের মতে, এই দুই উটকো বিষফোড়াই শুধু নয়, দলের ‘গোদা পায়ের ভর’ দেখানো জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাবু হয়ে বসে পড়াটা’ও সমান দায়ী। জেলার দুই মন্ত্রী, দুই মেয়র, আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান বা দলের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের আরো অন্তত ডজন খানেক নেতা এখন আর তার পাশে নেই, বলেই একটি সূত্রের দাবি। সম্ভবতঃ এসব আঁচ করেই নরেন্দ্রনাথ জেলা সদর আসানসোলে দলের জেলা অফিস থাকলেও, কারো অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে দুর্গাপুরে আলাদা একটি জেলা অফিস চালাচ্ছেন নিজের মতো করে। যেখানে তার পেয়ারের এক প্রাক্তন আর এক বর্তমান কো কর্মীর হুকুমদারিতে ‘আসল তৃণমূলী’রা নাকি ওই অফিসে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন – লাঞ্ছনা, অপমানের ভয়ে। আর গত মাসেই এনিয়ে দলের বরিষ্ঠ নেতারা তার সামনেই নরেন্দ্রনাথকে কার্যতঃ তুলোধোনা করেন, বলে একাধিক সূত্রের দাবি। চাপে পড়ে নরেন্দ্রনাথ সেদিন যেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি, তেমনি গুটিয়ে যান সোমবারও। তবে, এনিয়ে দলের বলিষ্ঠ নেতা ভি শিবাদাসন এদিন বলেন, “আমরা সকলেই নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক। আমরা দল করি। কারো কারো ভুল আচরণের কিছু রিপোর্ট দিদির কাছে নিশ্চয় গেছে, তাই তিনি হয়তো শাসন করেছেন তার মতো করে, এনিয়ে আমাদের মতো লোকেদের কিইবা বলার থাকতে পারে?” রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তিনি শুধু বলেন,” আমাদের পরিষদীয় নেত্রীই বৈঠক নিয়ে বাইরে কথা বলতে পারেন, আমরা এনিয়ে বলার কেউই নই।”

এই ঘটনার খবর শিল্পাঞ্চলে জানাজানি হতেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ আরেক গোষ্ঠী এই ঘটনার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে জোর প্রচার চালায়। এদিন মুখ্যমন্ত্রীর ধমকের এই ঘটনায় উল্লাসিত তৃণমূল কংগ্রেসের ওই বিক্ষোদ্ধ গোষ্ঠীর লোকজনেরা, তাদের মতো করে নতুন জল্পনা উস্কে দেয় শিল্পাঞ্চলে। শিল্পাঞ্চলের আনাচে-কানাচে এখন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা জোর প্রচার চালাচ্ছেন যে শিল্পাঞ্চলে খুব তাড়াতাড়ি নাকি নক্ষত্র পতন হতে চলেছে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments