নিজস্ব সংবাদদাতা, পানাগড়ঃ – গ্রীন ট্রাইবুনালের নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে বর্ষাকালেও অবৈধ উপায়ে অজয় ও দামোদর নদে চলছে অবাধে দেদার বালি পাচার। বহু চেষ্টা করেও ‘ঠুটো জগন্নাথ’ পশ্চিম বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন তা ঠেকাতে ব্যর্থ। নীরবে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধে লুঠ চলছে ‘লুঠেরই স্বর্গরাজ্য’ কাঁকসায়। আর কাঁকসাকে এই বালি লুঠের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ও কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশকর্মী একত্রিত হয়ে মাফিয়াদের সহযোগিতা করছে বলেই অভিযোগ সর্বত্র শোনাযায়।
কাঁকসার অজয় নদ থেকে এখানকার বনকাটি, দেউল, সাতকাহানিয়া ও দামোদরের আইমা, সিলামপুর ঘাট, বুদবুদের শালডাঙা, মুন্সীপুর, শাঁকুড়ি ঘাটে এভাবেই চলছে খুলেআম বালি চুরি। এই বর্ষায় দামোদর নদে ও অজয় নদে কোনরকম বালি তোলার অনুমতি নেই প্রশাসনের। দেশের গ্রীন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মোতাবেক। তা সত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দামোদর নদের ওপর সিলামপুর, আইমা, শাঁকুড়ি, শালডাঙা ও মন্সীপুর ঘাটে অবাধে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। বুদবুদের শাঁকুড়ি, শালডাঙা ও মন্সীপুরঘাটে রোজই প্রকাশ্য দিবালোকে ৪০-৫০ টি ট্রাক্টরে করে চলছে বালি পাচার। আবার সিলামপুর, আইমা ঘাটে রাতের অন্ধকার নামতে নির্বিচারে চলছে জেসিবি, পোকলেন মেশিন দিয়ে বালি তোলার কাজ।
নিম্নচাপের রেশ কাটতেই গত ৩-৪ দিন ধরে শুরু হয় বালি পাচারের রমরমা কারবার। মুলত দামোদর নদের ওপর সোনামুখির ডিহিপাড়া ও পলাশডাঙা মৌজায় রাত ১০ টার পর চলছে অবাধে বালি তোলার কাজ। ওই দুই মৌজা থেকে কমপক্ষে ১০০ টি ট্রাক্টর ও ৭০ টি ডাম্পারে করে চলছে বালি পাচার। একই রকম ভাবে অজয় নদের ওপর কাঁকসার সাতকাহানিয়া, বাঁশতলা শ্মশানঘাট, জঙ্গলঘাট, দেউল ঘাট, পেয়ারা বাগান ঘাটে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। দশ চাকা থেকে ১৬ চাকার লরি ডাম্পার, ট্রাক্টরে বালি বোঝাই হয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে অবাধে যাতায়াত করছে। সিলামপুর এলাকায় কয়েকজন ট্রাক্টর চালক সম্প্রতি মুখ ফসকে স্বীকারও করে নেয়, দৈনিক ৪০০ টাকা করে লোকাল ট্যাক্স মানে কাটমানি দিতে হয়, প্রতি ট্রিপে। দামোদরের সিলামপুর, আইমা ঘাটে ট্রাক্টর পিছু ৬-৮ হাজার টাকা ও ডাম্পার পিছু ১৫-২০ হাজার টাকা মাসোহারা রেট রয়েছে, বলে জানা গেছে। আবার গলসী-১ নং ব্লকের শাঁকুড়ি, শালডাঙা, মুন্সিপুরঘাটে ট্রাক্টরের প্রতিদিন ৪০০ টাকা মাসোহারার রেট রয়েছে। একই রকম ভাবে অজয় নদের ওপর কাঁকসার বনকাটি, সাতকাহানিয়া, দেউল ও জঙ্গলঘাটে মাসোহারা রেট বাঁধা রয়েছে।
কাঁকসার দামোদরের সিলামপুর, আইমা ঘাটে রাত ১০ টার পর ওইসব বালি বাঝোাই লরি, ডাম্পার পানাগড়ের ওপর দিয়ে উঠছে জাতীয় সড়কে। তারপর সোজা চলে যাচ্ছে কলকাতায়। এছাড়াও দিনেদুপুরে ৪০-৫০ ট্রাক্টর বিভিন্ন ঘাট থেকে বালি সরবরাহ করছে। ট্রাক্টর বোঝাই ওইসব বালি পানাগড় সিলামপুর রোডের পাশে পানাগড় ও শালডাঙা ক্যানেল পাড়ে মজুত করা হচ্ছে। আবার সাতকাহানিয়া এলাকায় দিনভর ৩৫-৪০ টি ট্রাক্টরে বালি পাচার হচ্ছে। সেখানের জঙ্গলে ও মিলের মাঠে মজুত করা হচ্ছে বালি। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে মজুত বালি লরি, ডাম্পারে পাচার হচ্ছে অন্যত্র।
মুখ্যমন্ত্রী জেলাপ্রশাসনকে কাঁকসা ও বুদবুদের ওপর নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু ওই নির্দেশিকাই সার! কাঁকসা ও বুদবুদ দুই থানা এলাকা মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। দুই থানার ওপর দিয়ে অবাধে চলছে অবৈধ বালি পাচারের রমরমা কারবার। লোকসান হচ্ছে রাজ্যের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব। বেপরওয়া অবৈধ বালি বোঝাই গাড়ী যাতায়াতে ভেঙে পড়ছে গ্রামের রাস্তা। অতীষ্ঠ সাধারন পথচলতি মানুষ থেকে স্কুল পড়ুয়ারা। ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়। অবৈধ বালি উত্তোলনের জেরে বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথও। ভেঙে পড়ছে নদীর পাড়। বিপন্ন হচ্ছে কৃষিজমি। বর্তমানে দামোদরের গ্রাসের মুখে পশ্চিম বর্ধমান জেলার দামেদর নদ তীরবর্তী কাঁকসা ব্লকের সিলামপুর, আইমা, পুর্ব বর্ধমানের গলসী-১ নং ব্লকের বুদবুদের শাকুড়ি, শালডাঙা, মুন্সীপুর, ভরতপুর এলাকার চাষজমি। চরম আতঙ্কে গ্রামবাসীরা। আর নদী ভাঙনের কারন হিসাবে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলনকে দুষছে এলাকাবাসীরা। মাঝ নদীর বালি তুলতে গিয়ে বালি কারবারিরা নদীর জলস্রোতের গতিপথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বালির বাঁধ তৈরী করে জলস্রোত নদীর পাড় দিয়ে ঘোরানো হচ্ছে। ফলে জলস্রোতের ধাক্কাতে ভাঙছে নদীর পাড়। যেভাবে নদীপাড় ভাঙছে, তাতে বহু চাষজমি, ঘরবাড়ী অচিরে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় এলাকার গ্রামবাসীরা ।
অবৈধ বালি পাচারে কোটি কোটি টাকার সরকারের রাজস্ব লোকসান হচ্ছে। তারপরও রাতের অন্ধকারে কাদের মদতে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন ? প্রশ্ন উঠছে ভুমি রাজস্ব দফতরের নজরদারি নিয়েও ।
স্থানীয় এলাকার গ্রামবাসী ও একটি বিশ্বস্ত সূত্র মারফত জানা গেছে দামোদর নদ থেকে সিলামপুর ঘাটে যে অবৈধ বালি উত্তোলন হচ্ছে তার মূল পান্ডারা হলেন জনৈক ‘অনুপ’ ,’কিরণ’ ‘বিলে’, ‘ডাবলু’ নামক কুখ্যাত সব বালি মাফিয়ারা। এদের প্রত্যেকের নামে অবৈধ বালি চুরি ও জেল খাটার নজিরও রয়েছে। আর এদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মত করে চলেছে কাঁকসা থানার একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশকর্মীরা। গ্রামবাসীদের আরো অভিযোগ এই সবের পেছনে রয়েছেন কাঁকসা এলাকার এক ‘প্রভাবশালী’ তৃণমূল কংগ্রেসের কৃষ্ণকায় ছিপছিপে এক নেতা, যার মুখে সবসময় বড়বড় কথা। এই দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস নেতার সাথে নাকি কাঁকসা থানার একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কর্মীদের সাথে মাখোমাখো সম্পর্ক থাকায় অবৈধ বালি পাচারে বিশেষ সুবিধা হচ্ছে বালি মাফিয়াদের, বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। কাঁকসা এলাকার একাধিক গ্রামবাসীদের অভিযোগ, শুধুমাত্র বালি পাচারের জন্যই কাঁকসা এলাকায় বালি মাফিয়ারা ও তাদের সহকারীরা একাধিক নতুন ট্রাক্টর কিনছেন। যারা এইসব ট্রাক্টর গুলি কিনেছেন তাদের এক টুকরো চাষযোগ্য জমি নেই বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। শুধুমাত্র বালি পাচার করে টাকা রোজগারের জন্যই এই ট্রাক্টর গুলি কেনা হয়েছে। সূত্র মারফত জানা গেছে দুর্নীতিগ্রস্ত কাঁকসার ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও নাকি কিছুদিন আগে সোনালিকা কোম্পানির ৪ টি ট্রাক্টর কিনেছেন, বেনামে এই বালি পাচারের কাজের জন্য।
এ বিষয়ে কাঁকসা এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা পল্লব বন্দোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যে সকল বালি মাফিয়াদের নাম বলা হচ্ছে তারা সকলেই কাঁকসা ব্লকে এর বাসিন্দা সঠিক। তবে, এইসব বিষয়ে মন্তব্য করবো না। পশ্চিম বর্ধমান জেলার তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতির কাছ থেকে জেনে নিন।” এলাকায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সমাজকর্মী হিসেবে পল্লব বন্দোপাধ্যায় পরিচিত হলেও তিনি বালি পাচার কান্ডের কোন তথ্যই জানেন না ও এসব বিষয়ে মন্তব্য না করাই সহজেই অনুমান করা যায় যে বালি মাফিয়াদের দাপটে মুখ খুলতে চান না কেউই। এতটাই প্রভাব ও ভীতির সঞ্চার করেছে এইসব বালি মাফিয়ারা কাঁকসা অঞ্চলে।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র মারফত জানা গেছে দু-দিন আগেই বালি তোলার জন্য আইমা, সিলামপুর ঘাটে নতুন করে রাস্তা তৈরী করেছে মাফিয়ারা। খবর চাউর হতেই রাত্রে প্রায় দিনই দফায় দফায় অবৈধ বালি উত্তোলনের ঘাটে অভিযান হয় বাঁকুড়া জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু, আশ্চর্য্যের বিষয় – অভিযানের আগাম খবর ঠিকই চলে আসে বালি মাফিয়াদের কাছে। বাঁকুড়া থেকে সিলামপুর পৌঁছাতে কমপক্ষে ঘন্টা দেড়ক সময় লাগে। তার মধ্যে পগারপাড় হয়ে যায় মাফিয়ারা। এমনকি নদীতে নামা খান চল্লিশেক ডাম্পার ও জেসিবি মেশিন হুড়মুড়িয়ে উঠে যায়। গত শনিবার রাত্রে একই রকম ভাবে হানা দেয় বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি দল। রাত ১১ টা নাগাদ ঘাটে হানা দেয় প্রশাসনিক আধিকারিকরা। সেই খবর আগাম পৌঁছানো মাত্রই ঢিল খেয়ে মৌমাছিদের পলানোর মত পগারপার বালি ভর্তি করতে আসা ডাম্পার ও বালি মাফিয়ারা।
এখানে প্রশ্ন, প্রশাসনিক অভিযানের আগাম খবর কিভাবে পৌঁছায় মাফিয়াদের কাছে? তাহলে কি সরষের মধ্যেই ভুত লুকিয়ে? জানা গেছে, জেলার শীর্ষ কর্তারা অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। অভিযোগ, মাফিয়াদের কিছু বেতন ভোগী সোর্স রয়েছে প্রশাসনেরই অন্দরে। যারা দুর্গাপুর ব্যারেজ, পানাগড় রেলপার এলাকায় দিবারাত্রি নজরদারি রাখে। এমনকি সিলামপুর আইমা রোডে মোটরবাইক নিয়ে টহল দেয় মাফিয়াদের ওইসব গুপ্তচরেরা। পরিস্থিতির বিষয়ে আগাম সতর্ক করে জানিয়ে দেয় তারা বালি মাফিয়াদের। প্রশাসনিক গাড়ী ঢোকার আগাম খবর এভাবেই পৌঁছে যায়। আর তাতেই সতর্ক হয়ে যায় বালি মাফিয়ারা। অভিযোগ পুলিশের কিছু লোকাল সোর্স ও স্থানীয় কিছু গ্রামীন পুলিশ কর্মীরা ৫০০টাকা আর মদের একটি বোতলেই বিকিয়ে যায় মাফিয়াদের কাছে। এমনকি এই সব লোকাল সোর্স ও স্থানীয় কিছু গ্রামীন পুলিশ কর্মীরা বেমালুম বালি চোরাচালানের ভুল তথ্য পাঠায় ও এলাকায় প্রশাসনিক অভিযানের গাড়ী ঢোকার আগাম সূচনা দেয় বালি মাফিয়াদের বলে অভিযোগ।
পশ্চিম বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা জানান,”অবৈধ বালি উত্তোলন কোনভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে সরাসরি ধরপাকড় করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ছে। পৌঁছানোর আগে, সরে পড়ছে বালি পাচারকারীরা। তবুও বিষয়টি দেখা হচ্ছে।”