জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- ‘ঢাকের তালে, কোমর দোলে/ খুশিতে নেচে ওঠে মন’- না, তখনো ওই বাচ্চাদের মন খুশিতে নেচে ওঠেনি। উঠবেই বা কী করে! আর্থিক কারণে ওদের অভিভাবকদের পক্ষে সন্তানদের জন্য নতুন জামা কিনে আনা সম্ভব হয়নি। পুজোর সময় অভিভাবকদের কেউ ঢাক, ঢোল, কাঁসর-ঘণ্টা বাজায়, প্যাণ্ডেল তৈরির কাজ করে, ফুচকা বা ফাস্ট ফুডের দোকান দেয়, পুজোর ফুল-বেলপাতা সরবরাহ করে। তার বিনিময়ে যে অর্থ পায় সেটাই ওদের আয়ের উৎস। শুধু ওদের নয়, পুজোর পুরোহিত, বস্ত্র ব্যবসায়ী সহ আরও অনেকের অতিরিক্ত আয়ের মূল উৎস এই পুজো মরশুম। মৃৎশিল্পীরা আছেন। গতবছর পুজোকে কেন্দ্র করে প্রায় ষাট হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এই সময় প্রত্যেকের বাড়তি আয় হয়।
এবছর আরজি করের দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে রাজনৈতিক বিতর্ক দানা বাঁধছে তাতে ওইসব গরীব পরিবারগুলি আতঙ্কে আছে। একটাই ভয় – শেষপর্যন্ত পুজোটা শান্তিতে কাটবে তো! মুখ্যমন্ত্রী জনগণকে উৎসবে ফেরার আহ্বান জানালে একদল ‘উৎসবে না’ ট্যাগ লাইন দিয়ে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করতে থাকে। তাতেই অজানা আশঙ্কা বাড়তে থাকে। এরা বাঙালির আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে। লক্ষ্য একটাই দুর্গাপুজোতে অশান্তি করা। গণেশ পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো সহ অন্যান্য পুজো নিয়ে এদের সমস্যা নাই। যত লক্ষ্য বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিকে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে এদের মূল লক্ষ্য বিচার নয়, অশান্তি পাকিয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখা! তাদের এই দাবি পূরণ হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণ দ্যাখা যাচ্ছেনা। বলা যেতেই পারে এরা আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
তিলোত্তমার নৃশংস পরিণতি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সব মহল থেকে অপরাধীর শাস্তির জন্য জোরালো কণ্ঠে দাবি উঠেছে এবং সঙ্গত। কিন্তু ‘উৎসবে না’ দাবি করে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। খোঁজ নিলে দ্যাখা যাবে এরা নিজের পরিবারের জন্য উৎসবের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। সন্তান সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক কিনে ফেলেছে। গরীব মানুষদের পক্ষে তো শপিং মলগুলোতে ভিড় করা বা অনলাইনে অর্ডার দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কারা ভিড় করছে বা অর্ডার দিচ্ছে?
যারা ‘উৎসবে না’ দাবি করছে আশা করা যায় তারা পুজোর ছুটি না নিয়ে নিজ নিজ অফিসে কাজ করবে, কোথাও বেড়াতে যাবেনা, কোনোরকম পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেনা, রেস্টুরেন্টে গিয়ে টেবিলের উপর হুইস্কির বোতল রেখে মুরগির ঠ্যাং চিবানো থেকে বিরত থাকবে, ওরা এবার বোনাসও গ্রহণ করবেনা। গরীব মানুষদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করবে! সম্পূর্ণ অহিংস পথে ওরা বিচারের দাবি তুলবে।
রাজ্যের একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল একটা তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে নিয়ে রাজনীতি করছে সেটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। যাদবপুরে স্বপ্নদীপের স্বপ্নকে যখন নষ্ট করে দেওয়া হয় তখন এদের কোনো কষ্ট হয়নি। উল্টে সেদিন সিসি ক্যামেরা বসাতে দেয়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে ওখানে সত্যিই অসামাজিক কাজ হতো তাই এতো বাধা? সাব্বির বা মতির মর্মান্তিক পরিণতির জন্য এদের চোখ দিয়ে জল পড়েনা। সত্যিই তো যার যায় তারই যায়। তিলোত্তমার মত স্বপ্নদীপ বা সাব্বিরের মা-বাবাও শোকাহত!
কে উৎসবে যোগ দেবে বা কে দেবেনা সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রী যেমন কাউকে উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পারেননা, তেমনি কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারেনা। ওটা সাধারণ মানুষের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক। উৎসবে ফিরুন’ যদি অন্যায় হয় তাহলে ‘উৎসবে না’ টাও অন্যায়। উৎসব ও বিচার প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলুক।
দুর্গাপুজো নিছক একটা উৎসব নয়। কোটি কোটি বাঙালির আবেগ ও জীবিকা এরসাথে জড়িয়ে আছে। করোনার সময় সেটা ভালভাবেই বোঝা গ্যাছে। দ্রুত অপরাধীদের শাস্তি হোক, সেটা সবাই চায়। ‘ফেক’ গল্প না ছড়িয়ে কারও কাছে কংক্রিট প্রমাণ থাকলে সেগুলো তদন্তকারীদের হাতে তুলে দিয়ে সে তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে সাহায্য করুক। কিন্তু বন্ধ হোক এক তরুণীর নির্মম পরিণতি নিয়ে নোংরা রাজনীতি।