জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য ও সেইসূত্রে মানহানির মামলা – সুরাতের একটি আদালতের বিচারপতি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়। নিয়ম মেনে তার সাংসদ পদ শুধু খারিজ হয়নি, ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন সহ আগামী আট বছর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কিনা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় দ্যাখা দিয়েছে। তার দলের আইনজীবীরা এরপর কি করবেন সেটা আইনের ব্যাপার।
পারিবারিক সূত্রে দলীয় পদ পেলেও এখনো পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে দিশেহারা দলকে নতুন কোনো দিশা দ্যাখাতে রাহুল ব্যর্থ। উল্টে তার বেশ কিছু কাজকর্ম অথবা সিদ্ধান্তহীনতা বিভিন্ন সময় দলকে বিপাকে ফেলেছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যখন বিজেপি বেকায়দায়, হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গ্যাছেন। নিজের অনুগামীদের পর্যন্ত দলে ধরে রাখতে পারেননি। কংগ্রেসের মত দক্ষিণপন্থী দলগুলোতে কেউই নিজের জায়গা বা পদ ছাড়তে চায়না। কিন্তু তিনি পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে চরম ব্যর্থ। ২০১৪ সাল থেকে কংগ্রেসের যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে আজও সেটা বন্ধ হয়নি। সুতরাং তার অনুপস্থিতিতে কংগ্রেসের খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে হয়না।
অথচ ব্যক্তিগতভাবে রাহুল সৎ, শিক্ষিত ও ভদ্র রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত। সংসদে তার বক্তব্য এবং সাংবাদিকদের সামনে নানা প্রশ্ন প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী সহ শাসকদল বিজেপিকে বিপাকে ফেলেছে। হয়তো এই কারণেই কি তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা শুরু হলো! এর আগে যাদের সাংসদ বা বিধায়ক পদ খারিজ হয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, ব্যতিক্রম রাহুল।
এসবই সাধারণ মানুষের জানা। সুতরাং এগুলো নিয়ে আলোচনা বৃথা। তার সাংসদ পদ খারিজ করার ফলে ভারতের রাজনীতিতে কি কি প্রভাব পড়তে পারে সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
রাহুল গান্ধী হলেন নেহেরু-গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকার। ব্যক্তিগতভাবে সে যতই ব্যর্থ হোকনা কেন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে কেউই ভারতীয় রাজনীতিতে ওই পরিবারের অবদান অস্বীকার করতে পারবেনা। ওই পরিবারের প্রতি মানুষের একটা আবেগ আছে। এখনো নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী ওই পরিবারকে টানতে বাধ্য হন। যে অভিযোগের ভিত্তিতে সেই পরিবারের সন্তানের সাংসদ পদ খারিজ করা হলো সেই ধরনের কু’কথা বিজেপি সহ বিভিন্ন দলের নেতারা অহরহ ব্যবহার করে থাকে। রাহুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে মমতার প্রতি প্রতিদিন যত কু’কথা গত বারো বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে এই রাজ্যের একটা বড় অংশ রাজনীতিবিদের জনপ্রতিনিধিপদ খারিজ হতে বাধ্য। মনে হয় কিছুদিন হয়তো সবাই সংযত থাকবে।
কংগ্রেস বাদে অন্যান্য বিরোধীদলগুলো বিজেপির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে চাইলেও নেতৃত্ব নিয়ে ছিল চরম সমস্যা। কংগ্রেস প্রতি ‘আপ’-এর অ্যালার্জি সবার জানা। মমতা কখনোই রাহুলের নেতৃত্ব মানতে রাজি নয়। আবার কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে প্রকৃত বিরোধী ঐক্য কখনোই গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এখন রাহুলের ঘটনা হয়তো অন্য কোনো চিত্রনাট্য গড়তে পারে।
তৃণমূলকে হঠাতে এই রাজ্যের যেসব কংগ্রেস নেতা গোপনে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল এরপর তারা কি করবে? নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য তারা কি বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাত যেটা এখন ওপন (open) হয়ে গ্যাছে, বজায় রাখবে।
যেকোনো ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে বিরোধীদলের নেতাদের হেনস্থা করা বিজেপির রাজনীতির একটা স্টাইল হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই বিরোধীদলগুলো একত্রিত হয়ে সেই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। যদিও সেই দলে তৃণমূলকে দ্যাখা যায়নি। এখন রাহুলকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলগুলোকে প্রকৃত অর্থে একজোট করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এটাও দ্যাখার মেনকা গান্ধী ও তার পুত্র বরুণ কি করে।হয়তো রাহুলের ঘটনা বিজেপির কাছে বুমেরাং হতে পারে।
যতই রাহুল ব্যর্থ হন অথবা মিডিয়া মমতা বা কেজরিওয়াল সহ কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রজেক্ট করার চেষ্টা করুক না কেন সর্বভারতীয় পরিচিতি একমাত্র রাহুলের আছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে একদিন তার মা সোনিয়া যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন আজ নেতৃত্বের প্রশ্নে যদি রাহুল সেই বিচক্ষণতা দ্যাখাতে পারে এবং বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে তাহলে বিজেপির কপালে দুর্দশা আছে। হয়তো দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলে যাবে।রাহুল যদি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ না পায় বিজেপি নিজের ব্যর্থতার জন্য কার দিকে আঙুল তুলবে? সহানুভূতির হাওয়া কিন্তু ধীরে ধীরে রাহুলের অনুকূলে বইতে শুরু করেছে।
পরিশেষে একটা কথা বলা যেতে পারে – রাহুলের ঘটনার পর যদি কু’কথার রাজনীতি বন্ধ হয় তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় পাওনা। আর যাইহোক অন্ধ সমর্থক ছাড়া কেউই কু’কথার রাজনীতিকে সমর্থন করেনা।