eaibanglai
Homeএই বাংলায়স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে লড়াই করে চলেছে 'রাজকুমারী' জ্যোতি

স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে লড়াই করে চলেছে ‘রাজকুমারী’ জ্যোতি

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,কলকাতাঃ- ‘বাবার মমতা কি বুঝতে না বুঝতেই’ পিতৃহারা হলো টালিগঞ্জের ফুটফুটে সাড়ে তিন বছরের মেয়েটি। বাবার কোলে চেপে ঘুরে বেড়ানোর বয়সে মায়ের হাত ধরে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হলো তাকে। মা-মেয়ের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তো জোটাতে হবে! ঐটুকু মেয়ে কী কাজ করবে, কেইবা কাজ দেবে! তবুও তার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়।

পিতৃহারা শিশুকন্যা ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সদ্য স্বামীহারা মধুমিতা দেবী তখন কার্যত দিশেহারা। বিশাল পৃথিবীতে তার যে মা ও মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। নিজের মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করলেন তিনি। প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে মা-মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াই দেখতে লাগল। সেই লড়াই অনেকটা রূপকথার গল্পের মত।

মাত্র বছর চারের বয়সেই মডেলিংয়ের কাজ শুরু করে মেয়েটি। একটি বিজ্ঞাপন কোম্পানির পোশাকের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসাবে তাকে দেখা যায়। বিনিময়ে কিছু অর্থ পায়। পরিমাণটা অল্প হলেও সেটাই তার প্রথম আয়, আনন্দটা প্রচুর। এইভাবেই সামান্য আয় মা-মেয়ের জীবনে যেন নতুন করে বেঁচে থাকার আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে। নতুন করে পথ দেখায়। সেটাই শুরু। পরে একাধিক বিজ্ঞাপনে কাজ করার সুযোগ সে পায়।

কোনো একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করার সময় সেখানকার সেটে বাচ্চা মেয়েটার দিকে নজর পড়ে অশোকনগরের একটি নৃত্য ও অভিনয় শিক্ষা কেন্দ্রের কর্ণধার রূপম ভট্টাচার্যের। মেয়েকে সেখানে ভর্তি করার মত আর্থিক সামর্থ্য মধুমিতা দেবীর না থাকলেও রূপম বাবু তাকে হতাশ করেননি। পরবর্তী ঘটনা চমকপ্রদ।

তবে বছর আটেক আগে চলার পথটা শুরু হয়েছিল হরিদেবপুরের একটি স্টুডিওর মালিক অপু-দীপুর হাত ধরে। সেদিন এবং আজও যদি তারা পাশে না থাকত তাহলে হয়তো কোথাও হারিয়ে যেত প্রতিভাময়ী মেয়েটি। পরিবারের একজন প্রকৃত সদস্যের মত তারা তাদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের সৌজন্যে টুকটাক বিজ্ঞাপনের কাজ মেয়েটি পায়।

এই মেয়েটি হলো প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী ‘রাজকুমারী’ জ্ঞানজ্যোতি নস্কর, মা মধুমিতা দেবীর আদরের ‘সোনা’। সুটিং সেটে সবাই তাকে জ্যোতি বলেই ডাকে।

স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জ্যোতির বর্তমান বয়স মাত্র ১৩ বছর। বাচ্চা মেয়ে। বিজ্ঞাপন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবের মঞ্চে তাকে নৃত্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়। নৃত্য প্রদর্শনের পরিশ্রম ও রাতজাগার ক্লান্তি তাকে গ্রাস করলেও সংসারের প্রয়োজনে তার থামার উপায় ছিলনা। থেমে গেলে ‘ডান’ হাত থেমে যাবে। কখনো কখনো তার নৃত্যে মুগ্ধ দর্শকদের চাপে তাকে অতিরিক্ত নৃত্য প্রদর্শন করতে হয়েছে। ওদিকে মেয়ের ক্লান্তি ও কষ্টভরা মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়া মা মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে সবার আড়ালে চোখের জল গোপন করে গেছেন। মেয়েকে একা রেখে তার যে কোনো কাজ করার উপায় নাই! একেই হয়তো বলে ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস!

সালটা ২০১৮, মডেলিং ও নাচের হাত ধরে অভিনয় জগতে জ্যোতির প্রবেশ ঘটে। ‘গোপাল ভাঁড়’ সিরিয়ালে রামলোচনের মেয়ের ভূমিকায় তাকে অভিনয় করতে দেখা যায়। যথেষ্ট বড় চরিত্র। এরপর একে একে ‘রানু পেল লটারী’, ‘কেশব’, ‘কৃষ্ণকলি’-তে ছোট শ্যামা, ‘প্রথমা কাদম্বিনী’-তে কাদম্বিনীর বড় মেয়ে প্রভৃতি ধারাবাহিকে তার অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নেয়। সে ইংরেজি ছবি ‘প্রোজেক্ট মৃত্যুঞ্জয়’-এ লিড রোলেও অভিনয় করে।

জ্যোতির বড় পর্দার প্রথম ছবি ‘লাড্ডু’। তনিমা সেন ও পায়েল সরকারের মত নামীদামি শিল্পীরা সেখানে ছিলেন। সুটিংয়ের সময় শর্ট ফিল্ম ‘পোস্টমাস্টার’-এ ‘রতন’-এর ভূমিকায় তার স্বাভাবিক অভিনয় সুটিং দেখতে আসা দর্শকদের মুগ্ধ করে। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি ছবিতে তার কাজ করা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ক্রিস একাডেমির র‍্যাম্প শো-২০২৩ এ সে বিজয়ীর শিরোপা লাভ করে। এবছর মহালয়ার সময় একটি বেসরকারি চ্যানেলে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে ছোট দুর্গার ভূমিকায় তাকে দেখা যায়। এইটুকু বয়সে বিভিন্ন কোম্পানির ৫০ এর বেশি প্রোডাক্টে সে মডেলিংয়ের কাজ করে ফেলেছে।

অভিনয়, নৃত্য, মডেলিংয়ের পাশাপাশি পড়াশুনোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী জ্যোতি।এক সময় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও আর্থিক কারণের জন্য বর্তমানে সে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।

এখানেই সে থেমে থাকতে চায়না। দেব ও কোয়েল ভক্ত জ্যোতি আরও উঁচুতে উঠতে চায়। মায়ের কাছে শোনা বাবার স্বপ্ন সে পূরণ করতে চায়। তার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে জ্যোতি। তার সৌভাগ্য সবসময় পাশে পেয়েছে মা’কে। অসুস্থ শরীর নিয়েও মধুমিতা দেবী মেয়ের পাশে থেকেছেন। পরিচালক ও সহ অভিনেতারা তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি তার জন্যেই প্রযোজক মালদহর আউটডোর সুটিং বাতিল করে দেয়।

জ্যোতির প্রতিভা সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা তথা নির্দেশক রাজকুমার দাস। তিনি বললেন – যেটুকু দেখেছি তার উপর ভিত্তি করে বলতে পারি মেয়েটির ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ঠিকমত পরিচর্যা করলে আগামী দিনে তার মধ্যে পাওয়া যাবে এক বিশিষ্ট অভিনেত্রীকে। লাভ হবে বাংলা অভিনয় জগতের।

অন্যদিকে জ্যোতির মা মধুমিতা দেবী বললেন – সদ্য স্বামীহারা এক নারী তার শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কার্যত দিশেহারা। সন্তানকে একা ফেলে কাজের খোঁজে কোথাও যেতে পারিনি। আমার সন্তান ঐটুকু বয়স থেকে আজও মা-মেয়ে দুজনের পেটের ভাত জুটিয়ে যাচ্ছে। যারা কন্যা সন্তান হলে দুঃখ করেন তাদের বলব আমার মেয়েকে দেখে হতাশা দূর করুন। আমি আমার মেয়ের জন্য গর্বিত। আগামী দিনে হয়তো সমগ্র বাংলা তথা দেশ গর্ববোধ করবে।

আমরাও আশাবাদী অভিনয় জগতে অদূর ভবিষ্যতে জ্যোতির জ্যোতি অবশ্যই প্রকাশ পাবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments