জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রতি মাসে পুজো লেগেই আছে। প্রতিটি পুজোকে কেন্দ্র করে হয় উৎসব – কখনো আঞ্চলিক, কখনো বা সমগ্র রাজ্যজুড়ে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। এখানে লক্ষাধিক দুর্গাপুজো হয়। বড় বড় মণ্ডপ হয়। সমস্ত ধর্মের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে ভিড় করে। বিসর্জনের সময় শোভাযাত্রা বের হয়। ইদানীং রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কার্নিভ্যালও হচ্ছে। কালীপুজোর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কালীপুজোর সময় নৈহাটি, তকিপুর প্রভৃতি জায়গায় ভিড় দেখলে চমকে যেতে হয়। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় আলোকসজ্জা দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের জন্য রেলদপ্তর বিশেষ ট্রেন দিতে বাধ্য হয়। এছাড়া রাস উৎসব, দোল উৎসব সহ আরও বহু স্থানীয় উৎসব আছে। স্থানীয় হলেও সেসব জায়গাতেও সমগ্র সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড় খুব একটা কম হয়না। শুধু এই রাজ্য নয় অন্য রাজ্যের মানুষও নিজ নিজ উৎসবে মেতে ওঠে।
২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিনের সময় ব্যাণ্ডেল চার্চে বা পার্কস্ট্রীট সহ বিভিন্ন চার্চে মানুষের উৎসাহ দেখলে কে বলবে ওটা খ্রিষ্টানদের উৎসব। কেকের ব্যবসা এইসময় সর্বাধিক হয়। সান্তাক্লজ সেজে কত সহৃদয় মানুষ যে দুস্থদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে তার কোনো হিসাব থাকেনা।
রমজান মাস চলাকালীন ইফতার পার্টির টেবিলে অথবা মাসের শেষে খাওয়ার টেবিলে সমস্ত ধর্মের মানুষকে দ্যাখা যায়।
মাঝে মাঝে টুকরো ঝামেলা হলেও সবাই মিলেমিশেই উৎসব পালন করে। সেখানে থাকেনা কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ। এটাই ভারতবর্ষের মূল বৈশিষ্ট্য – বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।
অথচ গত কয়েকবছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশ জুড়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটছে সেটা তো কখনোই কাম্য নয়। এই বছর পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই ধর্মীয় উৎসব যেভাবে সাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হলো সেটা কি কেউ আশা করেছিল? আনন্দ উৎসবে কেন ঝরবে রক্ত? যাকে কেন্দ্র করে আমাদের মহাকাব্য রামায়ন রচিত সেই পুরষোত্তম রাম কখনোই এটা চাননি। হাইকোর্টের নির্দেশে ধর্মীয় উৎসব পালিত হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে অথবা শোভাযাত্রায় ভক্তদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে – এর থেকে লজ্জার কি আছে? আনন্দ উৎসব কি আইনের বেড়াজালে আটকে রাখা যায়?যেভাবে একাধিক রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে গ্যালো তাতে তো শুধু এই রাজ্যের পুলিশ ব্যর্থ বলা যাবেনা। আনন্দ করতে গিয়ে যারা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলো তাদের বা তাদের পরিবারের কথা কে ভাববে?
ঘটনার দায় কার – উদ্যোক্তাদের না একদল ব্যর্থ রাজনীতিবিদের যারা রামকে আঁকড়ে ধরে রাজনীতির ময়দানে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইছেন? আমাদের দেশে প্রতিটি রাজ্যে আলাদা আলাদা উৎসব হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় নিজেদের দৈনন্দিন দুঃখগাথা। উৎসবের উপর নির্ভর করে ব্যবসা বাণিজ্য। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীরা উৎসবের জন্য শুভেচ্ছা জানান। অনেক সময় বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকেও পাওয়া যায় শুভেচ্ছা বার্তা।
সুতরাং সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে নাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে আদালতের রায়ে উৎসবের পায়ে শৃঙ্খল পড়ে যাবে। তার থেকে পারস্পরিক দোষারোপ না করে হাতে হাত মিলিয়ে উৎসবকে সামগ্রিক রূপ দেওয়া হোক। শুভবুদ্ধি কি জাগ্রত হবে?