জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, বাঁকুড়া:– ২০০৮ সাল। রাজ্যে তখন বিরাজ করছে বাম-রাজত্ব। ওদিকে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল মহল জুড়ে মাওবাদীদের দাপট। আতঙ্কিত এলাকার মানুষ। বোমা ও জঙ্গল মহল জুড়ে যৌথ বাহিনীর ভারী বুটের শব্দ এবং বাতাসে পোড়া বারুদের গন্ধ গায়ে মেখে ঘুমাতে যেত এলাকার মানুষ। একইভাবে ঘুম ভাঙত তাদের। এলাকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে মাওবাদীদের হাতে প্রাণ গেছে বহু বাম নেতা-কর্মীর। আতঙ্কে তাদের অনেকেই বাড়ি ছাড়া। সাধারণ মানুষও বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পেত। চারদিকে বিরাজ করছে আতঙ্কের পরিবেশ।
এরকমই এক পরিবেশে ২০১০ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারীর সন্ধ্যায় তৎকালীন সারেঙ্গা থানার আইসি রবিলোচন মিত্রের কাছে খবর আসে গোবিন্দপুর এলাকায় মাওবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে কয়েকটি পরিবার। কালবিলম্ব না করে মাওবাদীদের হাত থেকে পরিবারগুলিকে রক্ষা করার জন্য পুলিশবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আইসি নিজে। প্রকৃত সেনাপতির মত সামনে থেকে মাওবাদীদের সাথে লড়াই করেন। উভয় পক্ষের মুহুর মুহুর গুলির শব্দ ভেঙে খানখান করে দেয় রাতের নিস্তব্ধতা। আতঙ্কে জেগে ওঠে গ্রামবাসীরা।
পুলিশের গুলির আঘাতে আহত হয় বেশ কয়েকজন মাওবাদী। কিন্তু মাওবাদীদের গুলি এসে লাগে আইসির শরীরে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। তখন সব শেষ! সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। নিজের প্রাণের বিনিময়ে সেদিন তিনি অনেক মানুষের প্রাণ রক্ষা করেন। ২০১১ সালে রাজ্যে ঘটে রাজনৈতিক পালাবদল। দীর্ঘ চৌত্রশ বছর বাম জমানার পর রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মা-মাটি-মানুষ সরকার। ধীরে ধীরে জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরে। শোনা যায়না ভারী বুটের শব্দ, বাতাসে ভাসেনা পোড়া বারুদের গন্ধ।
প্রয়াত আইসি-র স্মৃতিতে ২০১২ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারী বাঁকুড়া জেলা পুলিশের উদ্যোগে এবং সারেঙ্গা থানার পরিচালনায় আয়োজন করা হয় ‘রবিলোচন মিত্র স্মৃতি’ দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রসঙ্গত ২০১৭ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সারেঙ্গা থানা প্রাঙ্গনে প্রয়াত আইসির ‘রবিলোচন মিত্র’-র একটি আবেক্ষ মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন বাঁকুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা।
ঐতিহ্য মেনে গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সারেঙ্গায় অনুষ্ঠিত হয় ‘রবিলোচন মিত্র স্মৃতি’ দৌড় প্রতিযোগিতা। বাঁকুড়া জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে এবার এই প্রতিযোগিতায় দুই ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুর, নদীয়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জেলার পুরুষ ও মহিলা বিভাগে দুই শতাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। এবার এই প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকজন শিশুও অংশগ্রহণ করে। স্থানীয় বড়গাড়রা হাইস্কুল থেকে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং শেষ হয় সারেঙ্গা থানা প্রাঙ্গনে। সকাল ৮ টা নাগাদ পতাকা নেড়ে প্রতিযোগিতার শুভ সূচনা করেন বাঁকুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মকসুদ হাসান।
পুরুষ বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে যথাক্রমে অনুপম মাহাত, অমল মাহাত এবং অমিত মাহাত। অন্যদিকে মহিলা বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে যথাক্রমে মুক্তি বায়েন, অতসী বায়েন ও মুক্তি রাজশ্রী দেবনাথ। সফল প্রতিযোগিদের হাতে সম্মানিক, ট্রফি ও শংসাপত্র তুলে দেন বাঁকুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মকসুদ হাসান, সারেঙ্গা রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ স্বামী তদ্বোধানন্দজী মহারাজ, রাইপুরের বিধায়ক মৃত্যুঞ্জয় মূর্মু, সারেঙ্গার বিডিও তমাল কান্তি সরকার, সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মৌসুমী সিংহ মহাপাত্র। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি অভিজিৎ বিশ্বাস, বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সদস্য সুব্রত মিশ্র, সারেঙ্গা ব্লকের ৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এবং এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবী ধীরেন্দ্র নাথ ঘোষ, সুমন ব্যনার্জী, বিশিষ্ট শিক্ষক রনজিত দাশ চক্রবর্তী সহ অনান্যরা। সারেঙ্গা থানার আইসি সুদীপ হাজরার তত্ত্বাবধানে সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন অনিমেষ মহান্তী।