eaibanglai
Homeএই বাংলায়অজয়, দামোদর গিলে রাজা এক ভিখারি গৌতমঃ অংশীদার পুলিশ, ভূমিকর্তা, শাসক, বিরোধী

অজয়, দামোদর গিলে রাজা এক ভিখারি গৌতমঃ অংশীদার পুলিশ, ভূমিকর্তা, শাসক, বিরোধী

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- গৌতমবুদ্ধ রাজপাট ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন, আর কাঁকসার এক গৌতম ভিখারী থেকে রাজা হয়েছেন এমনই যে, গিলে ফেলছেন অজয় দামোদরের মতো আস্ত দুই নদী, হজম করে ফেলেছেন ডজন ডজন পুলিশ অফিসার থেকে ভূমি কর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। রাজার টাকায় পেট চলছে তাদের আর ফুর্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন শাসক, বিরোধী দুই দলেরই কিছু ফড়ে থেকে মাতব্বর – সব্বার,মস্তান।

এদের কারো কারো আবার নাকি সটান দুই মন্ত্রীর ঘরে সহ শাসক দলের জেলা সভাপতির চৌকাঠে নিয়মিত হাজিরা বাঁধা।

ভিখারি গৌতমের গিলে খাওয়া নদীর কর্করে বালি, কড়কড়ে নোটের মধুর মশলায় রোজ দিনই তারিয়ে তারিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন রাজ্য পুলিশের কয়েকটি থানার দারোগা থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় চ্যাংড়া কিছু স্বঘোষিত নেতা আর রাজ্য ভুমি দপ্তর এর অন্তত হাফ ডজন বিএলআরও। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো পুলিশ ইন্সপেক্টর নাকি বালি লুঠের বাদশা ভিখারি গৌতমের সরাসরি স্লিপিং বিজনেস পার্টনারও। এমনকি ‘ব্র্যান্ড কে কে’ নামক অসাধু সিন্ডিকেট ও তৈরি করে ফেলেছেন এই ভিখারি গৌতম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা।

“সরকার চাইলে সিআইডি লাগিয়ে দেখুক – কিভাবে পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূমের কয়েকটি থানার ওসি ওই গৌতম নামের বালি ডাকাতের পার্টনার হয়ে কোটি কোটি টাকা উপরি কামিয়ে, অরণ্য ধ্বংস করে বসতির পর বসতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন রোজ,” – মত বাঁকুড়ার বড়জোড়া সহ চার জেলার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের।

বড়জোড়া পঞ্চায়েতের পাহাড়পুর গ্রামের ক্ষুব্ধ, হতাশ বাসিন্দারা গত বছরের ১২ নভেম্বর বড়জোড়ার ব্লক সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে গণস্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রতিবাদ লিপি জমা করেছিলেন, সুবিচারের আশায়। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে বালির ডাকাতরা যে বুক ফুলিয়ে বালি পাচারের পাকাপোক্ত সড়ক পথ বানিয়ে নিচ্ছে – সে কথা উল্লেখ করেন। তারপরও কেটে গেছে আরো দুটি মাস। কিন্তু, সরকারি আমলাদের চোখের সামনে বালির ডাকাতদের দৌরাত্মক কমাতো দূর, লুঠের বহর আরো বেড়েছে বহুগুণ। লুটতরাজের পথ প্রশস্ত করতে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে অন্তত ৩০০ গাছ।

আবার, গ্রীন ট্রাইবুনালের কড়া নির্দেশিকাকে বালিচাপা দিয়ে মাসে লাখ লাখ টন বে-ফিকির বালি লুট চলছে অবাধেই। অথচ এত কিছুর পরেও বড়জোড়া ব্লকের ভূমি আধিকারিক অতুল বাবুর সাফাই – তিনি নাকি এলাকায় নতুন এসেছেন, তাই এলাকার গ্রামগঞ্জ গুলি তার এখনও ঠিক মতন চেনা হয়ে ওঠেনি! পাহাড়পুর গ্রামের প্রকাশ্য বালি লুঠের অভিযোগে গ্রামবাসীরা দুমাস আগে ব্লক প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন কিন্তু সরকারি ভাবেই। কিন্তু, এবিষয়ে সেখানকার বি এল আর ও অতুল বাবুর ন্যাকামির বাহারে এবার গিরগিটি ও লজ্জা পাবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতুল বাবু বলেন, “পাহাড়পুরটা কোথায় আমি ঠিক জানিনা। নতুন এসেছি তো তাই ঠিক মতন চিনি না।”

দুর্গাপুর শহরের বেনাচিতির বাসিন্দা অতুল বাবু সাত মাসেও হয়তো চিনতে পারেননি পাহাড়পুর, কিন্তু, সরকারিভাবে গ্রামবাসীদের সমবেত অভিযোগের পরেও গত দু’মাসে পাহাড়পুরটা কোথায় – চিনতে না চাওয়ার নেপথ্যের কারণটা কি শুধুই তার আলস্য, নাকি জেনেবুঝে তার চিনতে না চাওয়া? তারমানে কি এটাই – সুরাহা চেয়ে যে সব অভিযোগ অনেক আশা ভরসা রেখে এইসব সরল সোজা গ্রামবাসীরা প্রশাসনের আধিকারিকদের হাতে জমা করেন, সেগুলি সবই ‘ছেলে ভোলানো’র কায়দায় ডাস্টবিনে ফেলে দেন এইসব অতুলেরা, নাকি আধিকারিকদের পকেট আরো ভারী হয় এমন সব প্রতিবাদ লিপি হাতে এলে – এ প্রশ্ন এখন পাহাড়পুরের মতো প্রায় সব অজয়-দামোদর দুই নদীর তীরবর্তী গ্রাম গুলির বাসিন্দাদের। আরো প্রশ্ন উঠেছে – সরকারের প্রশাসনে কি তবে এক দপ্তরের সাথে আরেক দপ্তরের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, নাকি সবকিছুর জবাব আসলে অন্যরকম? ভিখারী গৌতমের নাপিত চালে ‘আমলা গামলা’ সবাই কুপোকাত?

“জানেন, এইসব গাছ আমাদের গ্রামের ক্লাবের ছেলেরা, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এখানকার বনবিভাগের সহায়তায় ২০১৯ সালে অনেক কষ্ট করে লাগিয়েছিল,”বলে একসাথে জানালেন পাহাড়পুরের বাসিন্দা সঞ্জয় দাস, সাগর শিট, গঙ্গাধর বাগদি এবং নিরঞ্জন খান, সোমনাথ ব্যানার্জীরা। তারা বলেন,”প্রতিবছর বর্ষায় বাঁধে ফাটল দেখা দিচ্ছিল। জল ঢুকছিল গ্রামে। তাই, বন্যা রুখতে, বাঁধ বাঁচাতে আমরা এইসব গাছ লাগিয়েছিলাম, আর বালিচোরেরা জেসিবি, পোকলেন লাগিয়ে সব দুমড়ে মুচড়ে উপড়ে দিলো। পুলিশ, বনবিভাগ, ভূমি দপ্তর কিছুই করলো না আর উল্টে বালি ডাকাতেরা আমাদের থ্রেট করলো।”

উল্লেখ‍্য কিছু দিন আগে প্রশাসনিক বৈঠক চলাকালীন জেলার বালি পাচার নিয়ে ব‍্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । বৈঠক থেকেই তিনি এই পাচার বন্ধ করতে পুলিশ, বিএলআরও সহ সমস্ত প্রশাসনিক আধিকারিকদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। তার পরেও জেলার বালি পাচারে লাঘাম পরানো যায়নি। অজয় নদীর পারুলবেড়িয়া, কাপিষ্টা, চুরুলিয়া, কাঁকসা সহ একাধিক যায়গা থেকে প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে ডাম্পারের পাশাপাশি ট্রাক্টর বোঝাই করে বালি পাচার চলছেই। গত বুধবার গোপন সুত্রে বালি পাচারের খবর পেয়েই গভীর রাতে অভিযান চালায় অন্ডাল থানার পুলিশ । অন্ডাল থানার পলাশবন এলাকার রাস্তা থেকে প্রায় দুশো টন বালি সহ পাঁচটি ওভারলোড ডাম্পার আটক করে পুলিশ ।

আবার অন্য দিকে একটি বালি বোঝাই ট্রাক্টর বাজেয়াপ্ত করেছে আউশগ্রাম থানার অধীন গুসকরা বিট হাউসের পুলিশ। বালির অবৈধ কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে ট্রাক্টরটির চালক মানিক কিস্কুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গলসি থানার জয়কৃষ্ণপুরে তার বাড়ি। পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার ভোররাতে বিল্বগ্রামের দিক থেকে বড়াচৌমাথা-আনন্দবাজার রোড ধরে বালি বোঝাই ট্রাক্টরটি আসছিল। বনপাশ বাজারের কাছে পুলিশ সেটিকে আটকায়। বালির বৈধ কোনও কাগজপত্র ট্রাক্টরের চালক দেখাতে পারেনি বলে পুলিশের দাবি। ঘটনার বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অবৈধ খাদান থেকে বালি তুলে তা চড়া দামে বিক্রি করার জন্য ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে ধৃত চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছে পুলিশ।

কাঁকসার ভিখারী গৌতম দু-দুটি আস্ত নদী রোজ গিলছেন, কিন্তু তাও পূর্ব বর্ধমানের গোলসি, খণ্ডঘোষ,রায়না, জামালপুর, বীরভূমের খয়রাশোল,ইলামবাজার,পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা, পানাগড়, আউসগ্রাম, জামুরিয়া,পাণ্ডবেশ্বর, রানীগঞ্জ, দুর্গাপুর, বাঁকুড়ার বড়জোড়া, মেজিয়া, ইন্দাস, সোনামুখী,কোতুলপুর থানা গুলির ওসি বা ব্লক প্রশাসন সেসব আরাম করে উপভোগ করছেন। তবে, শুধু শুধু চুপচাপ নয়, জানা যায় – ভিখারী গৌতমের পোষা কিছু ফোড়ে, মস্তান রোজই নাকি ওইসব আধিকারিকদের নানান ফরমায়েসের সেবায় নিবেদিত থাকেন।

কিন্তু এইসব ফোড়ে তাহলে কারা? কয়েকটি সূত্রে বেশ কিছু পদবীহীন নাম উঠে এসেছে, যারা ভিখারী গৌতমের হয়ে মাসে মাসে বেশ কিছু থানা, ভূমি দপ্তর, ব্লক দপ্তর এমনকি জেলা প্রশাসনকেও সামলে আসছেন বুক চিতিয়ে। বাপ-মায়ের পদবী লুকিয়ে। তাই এইসব ফোড়েরা দেদার রাজ করছে আর অফিস খুলে তৃণমুল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি চিটিয়ে, লম্বা লম্বা সিগারেটে সুখটান দিয়ে, বা সূর্য ডুবলেই বোতলের ছিপি খুলে। রাজ্যের শাসকদলের তকমা আছে তাই কি তারা নির্ভয়ে? বিরোধীরা তবে চুপ কেনো? ভুক্তভোগীদের জবাব – “সব শেয়ালের এক রা। তলে তলে সব বখরায় চলে। সকলেই ঐ বুদ্ধং শরণং…”।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments