সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- গীতা পড়েও অনেক সময় আমরা এর অর্থ বুঝতে পারি না কিন্তু ভগবান স্বয়ং বলেছে গীতার কোন একটি শ্লোক বুঝে সেই অনুযায়ী জীবন ধারণ করলে আমরা অনায়াসে তাঁকে লাভ করতে পারব। কিন্তু আমরা যদি গীতার অর্থই বুঝতে না পারি তাহলে আমাদের কী করনীয়? আপনার মনের মধ্যে চলা এই প্রশ্নটিই
একবার একজন ভক্ত প্রশ্ন করেছিলেন, “বৃদ্ধ জীবন কাটানোর উপায় পড়েছি আপনার বইয়ে। গীতা পড়ি রোজ। মানে বুঝতে কঠিন লাগে। চেষ্টা করি আনন্দ পেতে।” এর উত্তরে স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ তাকে বলেন,“ বই বন্ধ করুন। গীতা শব্দটা এসেছে গীত বা গান থেকে। যেমন সঙ্গীত। অর্থাৎ গান গাওয়াই গীতার তাৎপর্য। কোথায় গাইতে হবে? সভা বা হলে নয়, জীবনের কুরুক্ষেত্রে আর এটা করলেই গীতা পড়ার আনন্দ পাবেন।এ জীবনের গান। সংঘর্ষময় অনিশ্চিত দৈনন্দিন জীবনে গান গেয়ে যাওয়া। নিজের জীবনকে সঙ্গীত করে তোলা, জীবনের বিস্ময়কে, সৌন্দর্যকে উপভোগ করাই গীতা পড়া। নিত্যদিনের প্রতিটি ঘটনা, পরিস্থিতি, অবস্থাকে আনন্দের দৃষ্টিতে দেখুন। শেষ বয়সে জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করুন। অফুরন্ত অবসর আজ আপনার। অফিসের চাপ নেই, সংসারের দায়িত্ব শেষ, খাদ্য-বস্ত্র-গৃহের অভাব নেই। ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতা। এই তো উপভোগের সময়। মৃত্যুর আশঙ্কা করে লাভ নেই কারণ এটা অনিশ্চিত, যে-কোনো সময় আসতে পারে। যে কটা দিন আছে, মহানন্দে কাটান।”
এরপর মহারাজ বলেন,“ একটা প্রশ্ন করি। ভোরে সূর্যোদয় দেখলে আনন্দ পান, কিন্তু কাগজওলা রাস্তা থেকে উপরে আপনাকে কাগজ ছুঁড়ে দিলে তা দেখে আনন্দ হয় না কেন? আইসক্রিম খেতে যত ভাল লাগে, লেবুর সরবতে ততটা কেন নয়? গল্প লিখতে যত আনন্দ পান, হিসেব করতে তেমনটা নয় কেন? কারণ কি? উপরে কাগজ ছুঁড়ে দেওয়ার ঘটনার মধ্যে যে মজা আছে তা আপনি কখনও ভাবেননি। লেবুর সরবত যে আনন্দ করে খাওয়া যায়, হিসেব করতেও যে সৃজনশীল হতে হয়, এটা আপনি লক্ষ্য করেননি আগে আর এভাবে ছোট-ছোট ঘটনায়, মামুলি কাজে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটা আপনি লক্ষ্য করেননি। মেশিনের মতো করে গেছেন এতদিন। আজ থেকে অন্যভাবে দেখুন, ভাবুন, করুন। সবকিছুর মধ্যেই আনন্দকে খুঁজুন, মজা পেতে চেষ্টা করুন। অনুকূল ঘটনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও। একটু চেষ্টা করে দেখুন। চায়ের মতো জলও খেতে পারেন আয়েশ করে? টিভির ব্রেকে বিজ্ঞাপনগুলি দেখতে পারেন মজা করে? সকালে দুধ আনতে গিয়ে কাল কি হয়েছিল আর আজ কি অভিজ্ঞতা হলো, দুয়ের পার্থক্য ও আপনার অনুভব লক্ষ্য করুন। অর্থাৎ যা বলতে চাইছি, নিত্যদিনের সামান্য ঘটনাগুলিকে দেখতে পারেন বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে?
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেও মনস্কামনা পূর্ণ হল না আপনার। লাইট বিল খুব বেশি এসেছে এ-মাসে। খবর পেলেন প্রিয় বন্ধুর দেহত্যাগের। কিভাবে নেন ঘটনাগুলিকে? দুঃখিত মনে? আচ্ছা এমন ঘটনাকে একটু অন্য চোখে দেখার চেষ্টা করতে পারেন আজ? আপনার জীবনের মহাকাশে অসংখ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে,কখনো গ্রীষ্ম, কখনো বৃষ্টি, আবার হয়ত শীত বা ফনী। এখন অমাবস্যা, কাল পূর্ণিমা। আবার পূর্ণিমার মতো অমাবস্যারও নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে। এই দুই সৌন্দর্যকেই উপভোগ করতে পারেন? দুয়ের মধ্যেই সঙ্গীত অনুভব করেন? বৃষ্টির মতো শীতেরও গান আছে। শুনেছেন কখনও?”
মহারাজ মনে করেন জীবনে সুখ দুঃখ সবের মধ্যে একটা সৌন্দর্য রয়েছে। কষ্টের মধ্যেও একটা আলাদা আনন্দ রয়েছে। বিরহের মধ্যেও রয়েছে এক উপভোগ্য জিনিস। এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলে জীবন আমাদের কাছে বরণীয় এবং আনন্দঘন হয়ে ওঠে। মহারাজ বলেন,“অনেকেই এভাবে নেয় না। তাদের কাছে শুধু সূর্যোদয়ই সুন্দর, মধ্যগগনের সূর্য নয়। সম্রাটই সুখী, রমতা সাধু নয়। তাদের কাছে প্রেম শুধু মিলন, বিরহ নয়। রাধা-কৃষ্ণ, লায়লা-মজনু, অমিত-লাবণ্যকে তারা বোঝে না। মীরার ভজন তারা কি বুঝবে? তারা তো escapist. জীবনের অখণ্ডতাকে তারা জানে না। তারা শুধু হাসি চায়, ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যেতে চায়, জীবনকে explore করতে চায় না। এজন্যই তো মহাভারত লিখলেন ব্যাসদেব। হাসি-কান্না, যুধিষ্ঠির-দুর্যোধন, অর্জুন-কর্ণ, গান্ধারী-দ্রৌপদী সব নিয়েই জীবন। এই সার্বিক জীবনকে দেখুন। আজ এমন সুযোগ পেয়েছেন আপনি। অবশ্য এক যুবকেরও আছে এই সুযোগ। হয়ে উঠুন মহাকাশ। উপভোগ করুন ছয় ঋতুর খেলা। জীবনের কুরুক্ষেত্রে যে সঙ্গীত চলছে তার সাথে সুর মেলান। গীতার তাৎপর্য অনুভব করুন।”





