সঙ্গীতা চ্যাটার্জী (চৌধুরী),বহরমপুরঃ- নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রচণ্ড রকমের তার্কিক একজন মানুষ ছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাথে সাক্ষাতে যিনি বলেছিলেন, তিনি ভগবান কে সচক্ষে দেখেছেন কিনা? এও বলেছিলেন যে, ভগবানকে তাকে দেখাতে হবে তবেই তিনি মানবেন যে, ভগবান আছেন। এই তার্কিক একগুঁয়ে মানুষটি একসময় প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে পড়ে মা দক্ষিণেশ্বরের কালীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন,অর্থ নয়,ধন নয়,কেবল ঞ্জান,বৈরাগ্য আর বিবেক। পরবর্তীতে নিজে গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে অবতার পুরুষ জেনে তিনি সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, জগত সংসারের জন্য এক শুভ সূচনা করেছিলেন বেলুড় মঠের স্থাপনার দ্বারা, বিদেশের মাটিতে পা রেখেও সনাতন ধর্মকে মহিমান্বিত করে গিয়েছিলেন তিনি নরেন্দ্রনাথ, তিনি তখন আর নরেন নন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ।
এই স্বামীজি পরবর্তীকালে বলেছিলেন তিনি মনে করেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মা কালীর অবতার, দেবী স্বয়ং তার নিজের কার্যের জন্যই রামকৃষ্ণের দেহ যন্ত্রকে পরিচালিত করেছিলেন আর সেই কারণেই ঈশ্বর না মানা নরেনকেও মা কালীকে মানতে হয়েছিল। স্বামীজি তার কথায় বলেছেন, ”…কালী ও কালীর সর্বপ্রকার কার্যকলাপকে আমি কতই না অবজ্ঞা করিয়াছি! আমার ছ’ বছরের মানসিক দ্বন্দ্বের কারণ ছিল এই যে, আমি তাঁহাকে মানিতাম না।
কিন্তু অবশেষে তাঁহাকে আমায় মানিতে হইয়াছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাকে তাঁহার কাছে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন এবং এখন আমার বিশ্বাস যে, সব কিছুতেই মা-কালী আমায় পরিচালিত করিতেছেন এবং তাঁহার যাহা ইচ্ছা, তাহাই আমার দ্বারা করাইয়া লইতেছেন। তবু আমি কতদিনই না তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছি।
আসল কথা এই, আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসিতাম। তাহাই আমাকে ধরিয়া রাখিত। আমি তাঁহার আশ্চর্য ভালোবাসা অনুভব করিয়াছি। তখনও পর্যন্ত তাঁহার মহত্ত্ব আমার নিকট প্রতিভাত হয় নাই। পরে যখন আমি তাঁহার কাছে নিজেকে সমর্পণ করিয়া দিলাম, তখন ঐ ভাব আসিয়াছিল। তাহার পূর্বে আমি তাঁহাকে বিকৃতমস্তিষ্ক একটি শিশু বলিয়া ভাবিতাম, মনে করিতাম- এই জন্যই তিনি সর্বদা অলৌকিক দৃশ্য প্রভৃতি দেখেন। এগুলি আমি ঘৃণা করিতাম। তারপর আমাকেও মা-কালী মানিতে হইল।
না, যে কারণে আমাকে মানিতে হইল, তাহা একটি গোপন রহস্য, এবং উহা আমার মৃত্যুর সঙ্গেই লুপ্ত হইবে। সে-সময় আমার খুবই ভাগ্য বিপর্যয় চলিতেছিল।… ইহা আমার জীবনে এক সুযোগ হিসাবে আসিয়াছিল। মা (কালী) আমাকে তাঁহার ক্রীতদাস করিয়া লইলেন। এই কথাই বলিয়াছিলাম, ‘আমি তোমার দাস।’ রামকৃষ্ণ পরমহংসই আমাকে তাঁহার চরণে অর্পণ করিয়াছিলেন।
…তোমরা বলিতেছ, ভবিষ্যতে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে কালীর অবতার বলা হইবে কি? হাঁ, আমিও মনে করি, কালী তাঁহার কার্য সম্পাদনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের দেহযন্ত্র পরিচালিত করিয়াছিলেন।
দেখ, আমার পক্ষে ইহা বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই যে, কোথাও এমন এক বিরাট শক্তি নিশ্চয় আছেন, যিনি নিজেকে কখনও কখনও নারীরূপে কল্পনা করেন এবং তাঁহাকে (লোকে) ‘কালী’ এবং ‘মা’ বলিয়া ডাকে। আমি ব্রহ্মেও বিশ্বাস করি। আর আসল ব্যাপারটা কি সব সময় ঠিক ঐরূপই নয়?…যেমন সংখ্যাতীত জীবকোষের সমষ্টিতেই ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়, যেমন একটি নয়–বহু মস্তিষ্ক-কোষের সমবায়ে চৈতন্যের উৎপত্তি হয়, ঠিক তেমনি নয় কি? একত্ব মানেই বৈচিত্র্য। ইহাও ঠিক সেইরকম। ব্রহ্ম সন্বন্ধেই বা ভিন্ন ব্যবস্থা কেন? ব্রহ্মই আছেন, তিনিই একমাত্র সত্তা, কিন্তু তবু তিনিই আবার বহু দেবতাও হইয়াছেন।…”