জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বীরভূমঃ- যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী বা প্লাটিনাম জয়ন্তী একটা আলাদা তাৎপর্য বহন করে আনে। শতবর্ষ হলে সেই তাৎপর্যের মাধুর্য আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। আবার সেটা যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে উৎসব পরিণত হয় পুনর্মিলন উৎসবে। বয়স অনেক কিছু কেড়ে নিলেও মুহূর্তের জন্য প্রবীণরা ফিরে পান ফেলে আসা বিদ্যালয় জীবনকে। শিশুসুলভ আনন্দে মেতে ওঠেন ওরা। স্মৃতিচারণের সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চিতে লিখে আসা নাম খোঁজার চেষ্টা করেন। ভুলে যান আজ সেই স্থান দখল করেছে ওদের সন্তান-সন্ততি অথবা নাতি-নাতনিরা। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশের সাক্ষী থাকার সুযোগ পায় বর্তমান প্রজন্ম। যেমন শতবর্ষের আলোকে সেই সুযোগ পেল বীরভূমের সাঁইথিয়া ব্লকের দেরপুর উচ্চ বিদ্যালয় (হাঃসাঃ)।
সেটা ১৯২৪ সালের মার্চ মাস। দেশ তখন পরাধীন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর সহ বেশ কিছু শিক্ষাব্রতী মানুষ ও ভারতপ্রেমী ইংরেজদের উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডানা মেলতে শুরু করলেও আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল দেরপুর গ্রামের বাসিন্দাদের। কাছাকাছি বিদ্যালয় বলতে বেশ কিছুটা দূরে সিউড়ি ও সাঁইথিয়া। দূরত্বের জন্য ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। অবশেষে এলাকাবাসীর আক্ষেপ দূর করতে এগিয়ে আসেন এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি শিশির বন্দ্যোপাধ্যায়। পথ চলা শুরু হয় দেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের। দেখতে দেখতে সেই বিদ্যালয় পৌঁছে গেল শতবর্ষের দোড়গোড়ায়।
শতবর্ষকে স্মরণীয় করে তুলতে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই বর্ষব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছে বিদ্যালয়টি। গত ৮ ই আগষ্ট ছিল বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবস। দ্বিতীয় কর্মসূচিতে বিশ্বকবিকে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একশটি বৃক্ষরোপণ করা হয়। সেগুলি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয় বর্তমান প্রজন্ম।
দিনটির স্মরণে একইসঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরমানন্দ দের তত্ত্বাবধানে ও অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক্তনীদের উপস্থিতিতে সঙ্গীত, নৃত্য ও কবিতা পরিবেশন করে বর্তমান প্রজন্ম। শিক্ষক মহাশয়রা দিনটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
অনুষ্ঠানে শুভম, রাহুল, সুকুমার, বাসব , প্রীতি, নীলাঞ্জনা, ব্রততী, রিংকী, দেবশ্রী , সরস্বতী প্রমুখ প্রাক্তনীদের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের তোর্সা, ঈশান, অনির্বাণ, বর্ষা, সৌমেন, মিলি, অন্তরা, প্রেয়সী, রাকেশ, নয়ন, নাসরিন সুলতানাদের উৎসাহ ছিল দেখবার মত।
প্রসঙ্গত, এর আগে শতবর্ষের অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের উদ্যোগে গত মার্চ মাসে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। সেখানে একশ জন প্রাক্তনী রক্তদান করেন। অনেক বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের ইচ্ছে থাকলেও বয়স জনিত কারণে তারা রক্তদান করতে পারেনি। এরজন্য তাদের মধ্যে আক্ষেপ থেকে যায়।
বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় আটশ জন। প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক সংখ্যা কম থাকলেও সীমিত সামর্থ্য নিয়েও তারা সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ভাল হলেও এখানেই তারা থেমে থাকতে চাননা। আগামীদিনের লক্ষ্য হলো জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি লাভ করা এবং সেটা শতবর্ষের মধ্যেই।
বিদ্যালয়ে অনেক কিছু থাকলেও একটা বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আক্ষেপ থেকে গেছে। অনেক বিদ্যালয়ে সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার থাকলেও এই বিদ্যালয়ে সেটা নাই।
বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাসরিন সুলতানা বলল – অন্য বিদ্যালয়ের পাস দিয়ে যাওয়ার সময় যখন সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার দেখি তখন আমাদের বিদ্যালয়ের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে চোখের কোনটা ভিজে ওঠে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের কণ্ঠেও শোনা যায় হতাশার সুর।
শতবর্ষের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিদ্যালয়ের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মানসিক কষ্ট দূর করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ কেউ কি এগিয়ে আসবেনা?
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হরষিত বিশ্বাস বললেন – আমাদের অনেক কিছুর অভাব থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নাই। তাইতো বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করার সাহস করেছি। তিনি আরও বললেন – আমি অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের আবেদন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। যদি চূড়ান্ত অনুষ্ঠানের আগে সুসজ্জিত প্রবেশদ্বারটি নির্মিত হয় সেটা হবে আমাদের অন্যতম সেরা পাওনা।