সুপর্ণা বিশ্বাস, বজবজ, দ: ২৪ পরগণাঃ- কালী অথবা কালিকা হলেন সনাতন হিন্দুধর্মে এক পরম আরাধ্য দেবী। তিনিই আদি-পরাশক্তি দেবী পার্বতীর অন্য এক রূপ। তাঁকেই মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্তা বলে মনে করা হয়। তন্ত্রমতে তিনি দশম মহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কথিত আছে ভদ্রকালী মহাশক্তির একটি বিশেষ রূপ। দেবী কালী ভাগবতপুরান অনুযায়ী তিনিই ব্রহ্মা,বিষ্ণু এবং মহেশ্বের। শাস্ত্রমতে তিনি আদি এবং তিনিই অন্ত।
মার্কেন্ডেয় পুরাণ মতে মহিষাসুরমর্দিনী চন্ডী ও ভদ্রকালী এক ও অভিন্ন । ঋক বেদে উল্লেখ করা আছে আদি পরাশক্তি তথা কালীই পরমব্রহ্ম । তিনিই সমস্ত শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জননী।কালিকাপুরাণ ও দেবীপুরাণ অনুসারেও ভদ্রকালী হলেন দেবী দূর্গা।
কালী হলো ‘সময়’ বা ‘কালের পূর্ণতা’র স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ,যার পুংলিঙ্গ ‘কাল’ যা ভগবান শিবের নাম। এই শব্দের অর্থ কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো বা ঘোর বর্ণ। মহাভারত(৪৷১৯৫)-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে তা দেবী আদিশক্তি পার্বতীর রূপ। মহাভারতে ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মাবহন করেন। হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখও পাওয়া যায়।
‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে- সময় ও মৃত্যু। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে “সময়ের থেকে উচ্চতর”। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে , কালী শব্দটি কৃষ্ণবর্ণ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত অর্থে কাল-কে কলন করেন যিনি তিনিই (কাল+ঈ)কালী । সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্যে । আবার শ্রী শ্রী চন্ডীতে উল্লেখ মেলে যে –
‘ ইয়া দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে,
নমস্তসৈ , নমস্তসৈ নমো নমোঃ হে ’।
-এই কারনে অনেকেই কালীকে ক্রোধান্বিতা , রণরঙ্গিনী বলেও অভিহিত করে থাকেন।
দেবীর আবির্ভাব সম্পর্কে পৌরাণিক ব্যাখ্যা ও সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যাশক্তি মা পার্বতীর তপস্যা করতে থাকেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌশিকী মা মহামায়ার দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে মহাকাল বর্ণ ধারন করেন যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়। দেবী কালী অতি ভয়ঙ্করী। পাশাপাশি তিনি শক্তির দেবী। তিনি কোনো মায়াবী রূপের অধিকারী নন। দেবী কালীর পূজা অমাবস্যায় হয়ে থাকে। অমাবস্যা বলতে যখন চাঁদ আবর্তন করতে করতে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে তখন চাঁদের যে পৃষ্ঠ আলোকিত হয় তা দেখা যায়না । বরং যে পৃষ্ঠ আলোকিত হয়না তথা চাঁদের অন্ধকারের দিকটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখনই অমাবস্যা ঘটে। ফলস্বরূপ অমাবস্যার সময় পৃথিবীপৃষ্ঠ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকে। আর সেই অন্ধকার দেবী কালীর গায়ের বর্ণের মতনই গাঢ় কালো। সেই সাথে অমাবস্যার রাত্রি এক ভয়ঙ্কর আবহ স্বরূপ। সেই অর্থে মা কালীও ভয়ঙ্কর বার্তার দ্যোতক। আর সেই কালো অর্থেই জগৎপ্রকৃতির পাশাপাশি মানবমনেও তমোসাচ্ছন্ন আবর্ত সৃষ্টি হয়। সেই কারণে দেবী কালীর পূজা করা হয়। সেই অর্থে সবমিলিয়ে বলা যায় কালী পৃথিবীর রূপক।
দেবী কালী বা কালীকা মহাদেবের শক্তি। শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে গেলে শিব শক্তিহীন হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে দেবী কালীর যে ভয়ঙ্কর রূপের পরিচয় পাওয়া যায় তথা কালীর সাথে শিবের সম্পর্ক – শবরূপী অথবা জড়রূপী। কালী প্রকৃত অর্থেই শক্তির অর্থবাহক। যে শক্তি সাধনার অন্যতম উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে কালীপূজা সম্পন্ন করে দেবীর কাছে কার্যসিদ্ধির জন্য শক্তি এবং সাহস প্রার্থনা করে সেকালের ডাকাত সর্দাররা তার দলবল নিয়েডাকাতি করতে বেরিয়ে যেত। বিশেষত অমাবস্যার দিনগুলিতেই তারা ডাকাতি করতে যেত। আর ডাকাতদের আরাধ্যা কালী মূর্তিকেই ডাকাতকালী বলা হয়ে থাকে। ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী ১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন বিশ্বনাথ সর্দার যিনি বিশে ডাকাত নামে খ্যাত। এছাড়াও রঘু ডাকাত, ভবানী পাঠক নামে প্রমুখ ডাকাত সর্দাররা সেকালে প্রত্যেকেই কালীর উপাসক ছিলেন। শুধু তাই নয় তন্ত্রমতে দেবীর সাধনা করতেন। সাধককে স্বয়ং দেবীর প্রকাশ রূপে সাধারণের মধ্যে আত্মস্থ করতে লক্ষ্য করা যায়। ক্রমান্বয়ে দেবী কালীকা বা কালী উমার প্রতিস্থাপক রূপে নিতান্ত ঘরের মেয়েটি হয়ে পূজিতা হতে থাকেন।
দেবী কালীকার যাত্রাপথের ইতিহাস পর্যালোচনায় লক্ষ্য করা যায় এই বিস্ময়কর ভাবের পরিবর্তন। অর্থাৎ ভয়ঙ্কর থেকে অভয়প্রদানকারী। এক বিশেষ ধারার সঙ্গীত প্রবাহ যা শ্যামাসংগীত নামে প্রচলিত। তার মধ্যেও সেই অভয় রাত্রিরই রূপ বর্ণনা ও আহ্বান লক্ষ্য করা যায়।
প্রকৃত অর্থে অভয়দাত্রীকে নিজ হৃদয় মধ্যে স্থাপনা করাই সাধকের মূল লক্ষ্য । সে অর্থে সাধক বলতে সমগ্র উপাসকদের চিহ্নিত করা যেতে পারে, যারা নিজহৃদয়ের তমসা থেকে এক আলোকোজ্জ্বল স্তরে উন্নীত হতে চায়।