সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা কি একই না আলাদা বিষয়? এই নিয়ে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। একবার এক ভক্তও এই নিয়ে প্রশ্ন করেন স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজকে। তার উত্তরে মহারাজ যা বলেছেন তাই আজ বলব।
ওই ভক্ত প্রশ্ন করেন,“ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা কি একই অথবা পৃথক বিষয়?”এর উত্তরে স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ বলছেন, “ ধর্ম (religion) যেখানে শেষ, আধ্যাত্মিকতা (spirituality) সেখান থেকে শুরু। ধর্ম হলো বিশ্বাস-প্রথা-সাধনা, আর আধ্যাত্মিকতা অনুভব।
1। গাছ পোঁতা, জল দেওয়া, চারদিকে বেড়া লাগানো, এসব ধর্মের বিষয়। আর গাছে ফুল ফুটলে তা দেখে মুগ্ধ হওয়া, আনন্দে মন-প্রাণ ভরে যাওয়া হলো আধ্যাত্মিকতা। ধর্ম বলে গাছ থেকে ঐ ফুলটি নিয়ে মন্দির সাজাও, কিন্তু আধ্যাত্মিকতা তাকে গাছে রেখে দিয়েই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করে।
2। ভজন, স্তোত্র, বিচার, জপ-কীর্তন, উপবাস, পুণ্য, সবই ধর্মের অঙ্গ। ধর্ম তো আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি।
3। রোজ দু’বেলা বসে তুমি যা করছো সেটা ধর্ম। এতে প্রস্তুতি আছে, পরিকল্পনা রয়েছে, চেষ্টাও, সেই সাথে মনের ওঠা-নামা। আর এই কাজে তুমি যে কখনও-কখনও হঠাৎ অন্য মাত্রার ঝলক (glimpse) অনুভব করো, সেটা আধ্যাত্মিকতা।
4। সাধনাটা ধর্ম, কিন্তু সাধনা করতে-করতে মন যখন শান্ত হয়ে যায় তখন তুমি পৌঁছে যাও আধ্যাত্মিকতায়।
5। একে তুমি কখনও অনুভব করো জাগতিক ক্ষেত্রেও। যখন সূর্যোদয় দেখে আনন্দে ভরে যায় মন, মহাকাশের বিশালতা চিন্তা করে বিস্মিত হও, প্রেমের উদয়ে পূর্ণতার অনুভব করো, গান শুনতে শুনতে ভুলে যাও সব কিছু, তখন এই আধ্যাত্মিকতারই ছোঁয়া পাও অজান্তেই। আর ধর্মীয় সাধনার মাধ্যমে একে অনুভব করো সচেতনভাবে।
6। ধর্ম হলো মনকে শান্ত করার চেষ্টা, আর শান্ত হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় আধ্যাত্মিকতা।
7। অতীতের (স্মৃতি) প্রভাব থেকে বর্তমানকে মুক্ত করে তাকে প্রতীকের সাহায্যে ভবিষ্যতের লক্ষ্যে (দিব্য অনুভব) নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই সাধনা। আর ঐ দীর্ঘ রাতের শেষে সূর্যালোকের প্রথম ছটাতেই শুরু হয় আধ্যাত্মিকতা। এতে অতীত-ভবিষ্যত নেই, আছে শুধু বর্তমান।
8। কিন্তু এ স্থিতিশীল (static) নয়। এতে পাবে নিত্য বর্তমানের অনুভব। তুমি তখনও গতিশীল, কিন্তু এই গতি স্পন্দিত, বর্তমান থেকে বর্তমানে।
9। ধর্ম হলো সীমিত আমি’কে নিয়ে ঘোরাফেরা। কিন্তু আধ্যত্মিকতা এই সীমাকে অতিক্রম করে যায়। চেতনা তখন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যায়।
10। তুমি তখনও আছো, কিন্তু ব্যাক্তি হিসেবে নয়, কোনো নারী নও, ছাত্রী- বাঙালি- হিন্দু- মধ্যবিত্ত- ওবিসি- মোহনবাগান- ভারতীয় নও আর তুমি। পাখি তখন খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে মহাকাশে উড়ছে। অনুভব করছে “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”। এ এমন এক সত্তা যার নাম নেই, রূপ নেই, সীমা নেই, এ শুধু চেতন সত্তা।
11। ধর্ম তো অন্যের আবিষ্কার। আর কেউ বলেছে, দেখিয়ে দিয়েছে যে পথ সেটা ধরে তুমি চলছো। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা তোমার অনুভব, তোমার আবিষ্কার, তোমার নিজস্ব পথ। ”
মহারাজ আরও বলেন,“তবে কি ধর্মের প্রয়োজন নেই? নিশ্চয়ই আছে। কলেজে ভর্তি হতে গেলে স্কুল-ফাইনাল পাস করতে হয়। বুদ্ধদেবকে দেখো। আধ্যাত্মিকতার উপরে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি দেব-দেবীর পূজা অস্বীকার করলেন। তিনি প্রতিমা বাতিল করে দিলেন। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস, আজ পর্যন্ত বুদ্ধের যতো মূর্তি তৈরি করা হয়েছে, হিন্দুধর্মেও তত মূর্তি নেই। ধর্ম নিয়ে পড়ে থেকে আধ্যাত্মিকতাকে ভুলে যাওয়া যেমন ক্ষতি করে মানুষের, তেমনি ধর্মকে অস্বীকার করে শুধু আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিলে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সাধক, আর তখন গড়ে ওঠে নতুন-নতুন প্রতীক। খ্রিস্টান ধর্মে এভাবে তৈরি হয়েছে ক্রুশ, যীশু ও মাতা মেরীর প্রতিমা। ইসলামে চাঁদ-তারা, সবুজ রঙ, কাবা মসজিদের কালো পাথর। অসীমকে অনুভব করতে হলে সীমিত বস্তুর সাহায্য নিতে হয়। বিজ্ঞানীরাও নানা প্রতীকের ব্যবহার করেন, কবি আঁকেন রূপকল্প, শিল্পী দেন রঙ।”





