ড.শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ- দেবী দুর্গা চলে গিয়েছেন কৈলাসে। এবার পালা সংসারের সুখ এবং সমৃদ্ধি কামনায় বাঙালির লক্ষ্মী আরাধনার।
এই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে সরাসরি যোগ রাত্রি জাগরণের। কারণ: “নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী/তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।” বলা হয়, এই পূর্ণিমা রাতে দেবী পৃথিবীর পরিক্রমায় বের হন। এই কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে যিনি জেগে থাকেন এবং পাশাখেলা করেন তাঁকে মা লক্ষ্মী কৃপা করেন। তাই দেবী লক্ষ্মীর আগমন প্রতীক্ষায় এদিন বাঙালি গৃহস্থেরা সারারাত ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান। জনশ্রুতি – এই প্রদীপ জ্বালানোর ফলেই বাংলার ইতিহাসের বিখ্যাত ধনী জগৎ শেঠ কুবেরের তুল্য ঐশ্বর্য লাভ করেছিলেন।
কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন বাড়িতে আলপনা দেওয়ার রীতি বহুল প্রচলিত। খড়িমাটি বা চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয় এই শুভ্র আলপনা। যে চৌকাঠ পেরিয়ে দেবী লক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করবেন সেখানে আঁকা হয় দেবীর পদচিহ্ন। আলপনাতে থাকে দেবীর বাহন পেঁচা, শঙ্খ, পদ্ম, ধানের শিষ, ধানের গোলা ইত্যাদিও। যেসব পরিবারে এই দিন দেবীর প্রতি ইলিশ মাছ উৎসর্গ করা হয় – সেইসব পরিবারের আলপনাতেও ইলিশ আঁকা হয়।
এদিন দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভের আশায় অনেকেই দেবীর নাম স্মরণ করেন। দেবী লক্ষ্মীর মন্ত্রে দীক্ষিতরা দেবীর ১০৮ নাম জপ ও অন্যান্য আচরণ পালন করেন। দেবীর কৃপা পাওয়ার আশায় অনেকেই দেবীর স্তোত্র পাঠ করেন। লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করেন বাঙালি ঘরের বধূরা।
দেবী লক্ষ্মীর এই পুজো হয় ঘট, প্রতিমা, সরা, ঝাঁপি, নবপত্রিকা কিংবা থোড়ের তৈরি নৌকোয়। লক্ষ্মী সরা হিসেবে প্রসিদ্ধ – ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা , সুরেশ্বরী সরা এবং শান্তিপুরী সরা। এই লক্ষ্মী সরায় প্রথা অনুসারে তিন, পাঁচ, সাতটি পুতুল আঁকা হয়। কলার বের ও দেবীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটকেও দেবী লক্ষ্মী রূপে কল্পনা করে পুজোর প্রচলন আছে।
এই কোজাগরী রাতেই নারকেলের জল পান করে জেগে থাকেন ভক্তরা। প্রচলিত বিশ্বাস – স্বয়ং কুবের একসময় এই পূর্ণিমায় এভাবেই দেবীর আরাধনা করেছিলেন। তাই এই রীতি।
মা লক্ষ্মীর এই পুজোয় ধানের শিস রাখার নিয়ম। দেবীর এক হাতে তা শোভিত হয়। দেবীকে চাঁদ মালাও দেওয়া হয়। পুজোয় রাখা হয় কয়েন, পান, কড়ি, ঘট, হলুদ, আতপ চাল, ঘি, দই, মধু ইত্যাদি। আর থাকে নারকেলের নাড়ু। সাধারণভাবে দেখা যায় এদিন দেবীকে যে নাড়ু দেওয়া হয় তার রং হয় সাদা। কারণ এই নাড়ু তৈরিতে গুড় নয় – উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় মিছরি। থাকে তিলের নাড়ু, ফলমূলও। খিচুড়ি, লাবড়া, লুচি, সুজি, নিরামিষ তরকারি, পুষ্পান্ন, পরমান্ন ইত্যাদিও থাকে।
অনেক পরিবারে দেবীকে ক্ষীর দেওয়া হয়। খইয়ের পিঠা রান্নার ঐতিহ্য আছে অনেক বাড়িতেই। আবার, অনেক পরিবারে পারিবারিক রীতি অনুসারে – এই শারদ পূর্ণিমায় খোলা আকাশের নিচে পায়েস রাখার ঐতিহ্য আছে। তাঁদের বিশ্বাস – এই রাতে চাঁদের আলো থেকে অমৃত বর্ষণ হয়। সেই অমৃত মিশে যায় এই পায়েসের সঙ্গে। তাই এই পায়েস গ্রহণ করলে দীর্ঘ জীবন লাভ হয়।
দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় কাঁসর, ঘণ্টা বাজাতে নেই। দেবী লক্ষ্মী প্রসন্ন হন শুধুমাত্র ভক্তিতেই – তাই ভক্তি ভরে তাঁর অর্চনা করলেই দেবী গৃহস্থের ঘরে অধিষ্ঠান করেন। প্রদান করেন – সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য।





