বিশেষ প্রতিনিধি, দুর্গাপুরঃ বাম আমলে দাপট চালিয়ে যাওয়া বেশ কিছু কর্মী, আধিকারিক একসময় যারা-ই নাকি আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থাকে “শাসন” করত, রাজ্যে পালাবদলের পর, গোড়ায় তারা বেশ সিটিয়ে ছিল। দপ্তরে ঢুকত দুরু দুরু বুকে। তৃণমূল কংগ্রেস করা লোকেদের দেখলে যেচে সামনে এসে হেসে হেসে কথা বলা শুরু করল, এমনকি কুশল বিনিময়ও। প্রাক্তন মন্ত্রী বংশগোপাল চৌধুরী কিন্তু তখনো চেয়ারম্যান। হরবখত “স্যালুট” প্রিয় এই কমরেড চোখের সামনে অসহায় হয়ে দেখতে থাকলেন, তার পোষ্য পেয়াদা সকল কেমন ভিন দরজায় লেজ নাড়ছে! এটাই বোধহয় পরিবর্তন!
না। আসলে ওটা পরিবর্তন নয়। তোষামোদ প্রিয় বংশ বা তার সাথীরাও নার্ভাস হয়ে গেছিলেন। এডিডিএ-তে জোর গলায় কাউকে হুকুম করার হিম্মৎ-টাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে, তার উঠোন ডিঙ্গিয়ে তার-ই “জানেমন”রা পরের ঘরে কড়া নাড়া শুরু করল। আর তাদের ভাবখানা এই-“বহুৎ সহ্য করেছি বাছাধন। এবার ‘পরিবত্তন’ এসে গেছে, গরম দেখালেই সব বলে দেব!”
প্রশ্ন-কি বলে দেবে ওরা?
উত্তর-ওরাও জানে, আরে যাকে চমকাচ্ছে সেও জানে-কি বলে দেবে। তবে, যাদেরকে ‘বলে দেবো’ বলে বাঁশের কঞ্চিরা চড়বড় করছিল, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের ‘হঠাৎ সাহেব’ দাদারা কোনও দিন সেসবের খোঁজ নিতেই চাইলেন না। ওঁরা অবশ্য অন্য কিছুর খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এজীবনে যত্রতত্র “স্যার” শোনার আশাটাই যখন ছেড়ে দিয়েছিলেন! স্রেফ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশমার জোরে ২০১১র পর তারা পাড়ার ‘স্টার’-এর মর্যাদা পেয়ে গেলেন। ওতেই গলে জল। সিপিএম জামানায় যাদের অর্থাৎ যে সব কর্মী, আধিকারিকদের ওরা দূর্নীতিবাজ, লুঠেরা বলতেন, ২০১১র পর গদিতে বসে এডিডিএ-র প্ল্যানিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, ল্যান্ড সেকশনের সেই সব বাস্তুঘুঘুদেরই ফুল-বেলপাতার অর্পণ নিতে শুরু করলেন বলে অভিযোগ। আর প্রমাণ? ভুরিভুরি আছে-বুক ফুলিয়ে সেইসব বাস্তুঘুঘুরা কিভাবে ভিটেতে ঘুঘু চরিয়ে ছাড়ছে আর কিভাবেই বা কার কার উঠোনে নগদ গুপ্তধনের খোঁজ পাচ্ছে। ভূতের রাজার বরপুত্ররা পায়ে জুতো গলিয়ে ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ সিটিসেন্টার, মুচিপাড়া, বামুনাড়া, আড়া, বিধানগরে গত ন’বছরে কি কি ন-কড়া, ছ’কড়া করে বেড়িয়েছে, সে সবই শুধু নয়, টান দিতে হবে বিনয় চৌধুরী পরবর্তী ‘আড্ডা’-র সমস্ত দস্তাবেজে। তবেই বের হবে ঝুলির ভেতরের আসলি বেড়াল। আটঘাট বেঁধে সেই কাজটিই এবার করা শুরু করেছে দিল্লির একটি তদন্তকারি সংস্থা আর কলকাতার একটি আইনী শলাদানকারী সংস্থা।পৃথকভাবে। তবে, দুর্গাপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে তদন্তকারিদের তিনজন আলাদা আলাদা করে ইতিমধ্যেই কাজ শুরুও করে দিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন সংস্থার মহানির্দেশক রাজেশ জৈন। তিনি বলেন, “দিল্লি থেকে আমরা সবকিছুরই নজর রাখছি। আমাদের নিয়ম মোতাবেক, আমরা বেশ কিছু বিষয়ে ইতিমধ্যেই এডিডিএ-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিকের কাছে অফিশিয়াল অভিযোগ দায়েরও করেছি”। তবে, তিনি জানান, “এডিডিএ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে ঠিক কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে, এখনো জানায়নি আমাদের কাছে। সরকারি সম্পত্তির অপব্যবহার বা লুঠ সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ই আমরা ওনাদের নজরে আনছি। ব্যবস্থা যদি ওরা না নেন, তবে দিল্লি থেকে একের পর এক ব্যবস্থা আমরা নেওয়া শুরু করব। দু’একটি ক্ষেত্রে দুর্গাপুরে আমাদের তদন্তকারি আধিকারিককে এডিডিএ-র জমি-বাড়ির দালালরা হেনস্থা, হুমকিও দিচ্ছেন। এসবও আমরা নথিভুক্ত করছি।”
আসানসোল, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জের জমি জালিয়াতি নিয়ে ‘জৈন’রা দিল্লিতে বসে চিন্তিত হলেও, শিল্পাঞ্চলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিশেষ কোনও হেলদোল নেই। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি এই একটি ইস্যুতে কেমন যেন ছন্নছাড়া। সিপিএমের আন্দোলন করায় ভয় থাকতে পারে, অতীতের হিসাবপত্র যদি কেউ চেয়ে বসে, এই ভেবে! তবে বিজেপির সমস্যাটা কোথায়? “শ্যালক-জামাইবাবু সম্পর্কটা তো আর শুধু ঘরেই নয়, ঘরের বাইরেও। যার জেরে জামাইবাবুর পথ সুগম হয়, তার জেরে শ্যালকেরা তবে বিপদে পড়বে কেন?”-প্রশ্ন সমাজকর্মী পরিমল অগস্তির। বক্তার নিশানায় এডিডিএ-র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় আর সদ্য বিজয়ী দুর্গাপুরের সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া, বোঝাই যায়! বললেন, “ওদের এখনো লোক নেই এসব নিয়ে লড়াই, আন্দোলন করার। ওদের আরও ম্যাচুরিটি দরকার”। (চলবে)