জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বেহালাঃ– পেশার তাগিদে রাতে যাত্রা ‘শো’ সেরেই নেশার টানে সকালেই ছুটে গেলেন বেহালার ‘শান্তি নিলয়’ বৃদ্ধাশ্রমে। তবে এই নেশা ড্রাগের নয়, সমাজসেবার নেশা। উনি হলেন কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হেল্পিং হ্যাণ্ডস’-এর প্রতিষ্ঠাতা পিয়ালী বসু।
গত ১৭ ই ডিসেম্বর জনপ্রিয় যাত্রা শিল্পী পিয়ালী দেবীর দলের সুদূর পশ্চিম বর্ধমানের জামুরিয়ায় ছিল যাত্রা ‘শো’। একদিকে ছিল ‘শো’-এর ক্লান্তি, অন্যদিকে ছিল দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি। কিন্তু সেবার টানে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ১৮ ই ডিসেম্বর সকালেই বাড়ি ফিরে পিয়ালী দেবী অন্যান্যদের সঙ্গে পৌঁছে যান সঞ্জয় দাম পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রমে। তেইশ বছর আগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে এই বৃদ্ধাশ্রমটি পথ চলা শুরু করে। বর্তমানে এখানে ৫০ জনের মত আবাসিক আছেন।
পরিকল্পনাটা আগেই ঠিক করা ছিল । পরিকল্পনা মাফিক ওখানে পৌঁছে যায় সংস্থার সদস্যরা। আবাসিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ওরা রকমারি খাদ্য সমৃদ্ধ মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করে। যদিও আবাসিকদের বয়স জনিত কারণে পিকনিকের স্টাইলে মধ্যাহ্নভোজনটা না হলেও সেখানে আনন্দের কোনো ঘাটতি ছিলনা। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একঘেয়ে সাদা-কালো জীবনে শিল্পীসহ একঝাঁক বিভিন্ন পেশার উজ্জ্বল মানুষদের পেয়ে আবাসিকরাও খুব খুশি। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই উচ্ছ্বাস ধরা পড়ছিল। হয়তো বয়সের ভার বা শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেই আনন্দের সেভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল না। নিজেদের পেশাগত ব্যস্ততার মাঝেও ওদের সঙ্গে কিছুটা সময় ধরে সংস্হার সদস্যরাও আনন্দে মেতে ওঠে। অসহায় প্রবীণ-প্রবীণাদের সঙ্গে একটা দিন কাটানোর সুযোগ পেয়ে ওরাও খুব খুশি।
পিয়ালী বসু ছাড়াও ‘হেল্পিং হ্যাণ্ডস’ এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মৌসুমী, সোমদত্তা, বনশ্রী প্রমুখ। অন্যান্য বার উপস্থিত থাকলেও এবার থাকতে না পারলেও নিজের কর্তব্য ভোলেননি সংস্হার সদস্যা দেবী। ক্যানসার আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী সুরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ৫০০ টাকা তুলে দেন পিয়ালীদের হাতে। এ এক বড় পাওনা। শুধু তাই নয় শোনপুরে ‘শো’ করতে গিয়ে জনৈক প্রধান শিক্ষিকা ও একজন যাত্রামোদী দর্শক পিয়ালীর হাতে ৫০০ টাকা তুলে দেন। মঞ্চেই সেই টাকা তিনি আজকের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেটা বজায় রাখেন।
প্রসঙ্গত সেবার লক্ষ্য নিয়ে ২০২১ সালের ২ রা জুন বিশিষ্ট অভিনেত্রী পিয়ালী বসুর হাত ধরে ‘হেল্পিং হ্যাণ্ডস’ পথ চলা শুরু করে। পাশে পেয়ে যান সেবার মনোভাবাপন্ন বেশ কয়েকজনকে। তারপর গত প্রায় ঊনিশ মাস ধরে সেবার জগতে বিশেষ ছাপ ফেলে সংস্হাটি। শিল্পী সুলভ ‘ইগো’ ঝেড়ে ফেলে পিয়ালী এবং তার দলের সদস্যরা সাহায্যের ডালি নিয়ে পৌঁছে গ্যাছে কখনো সুন্দরবনে, কখনো বা অযোধ্যা পাহাড়ের দুস্থদের পাশে। এবার তারা বেছে নেয় বেহালার বৃদ্ধাশ্রমটিকে।
সব থাকতেও ঐ অসহায় মানুষগুলো আজ পারিবারিক কারণে পরিবারের প্রিয় সদস্যদের থেকে দূরে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এ এক তীব্র মানসিক যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে ‘হেল্পিং হ্যাণ্ডস’ এর মত কোনো কোনো সংস্হা এখানে এলে ওরা খুব খুশি হয়।
যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পিয়ালী দেবী বললেন – পেশাগত ব্যস্ততার জন্য সেভাবে আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ হয়না। তবে রবিবার দুপুরটা দাদু-দিদাদের সাথে লাঞ্চ করে যে আনন্দ পেলাম তার কোনো তুলনা হয়না। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যায় – এ আনন্দের ভাগ হয়না। কথা বলতে বলতে পিয়ালীর কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল, শিল্পী সুলভ নয়, কিশোরী সুলভ উচ্ছ্বাস।
পিয়ালীর কাছে জানা গ্যালো যদি সহৃদয় ব্যক্তিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে ভবিষ্যতে বড় কিছু করার ইচ্ছে তাদের আছে। এখন দ্যাখা যাক পিয়ালীদের স্বপ্ন পূরণে কেউ এগিয়ে আসে কিনা! এলে হয়তো সবার মিলিত প্রচেষ্টায় আরও বেশি সংখ্যক অসহায় মানুষ উপকৃত হবে।