নীহারিকা মুখার্জ্জী, দুর্গাপুরঃ- তখনও সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি বৈদ্যুতিক আলো। দূরদর্শনে দেখা যেতনা মনোরঞ্জনমূলক অনুষ্ঠান, হাতে হাতে ঘুরতনা স্মার্টফোন। শহর থেকে গ্রাম – সন্ধ্যা হলেই হ্যারিকেনের আলোতেই কোনো কোনো বাড়িতে বসে যেত সাহিত্যচর্চার আসর। পরিচিত বা অপরিচিত সাহিত্যপ্রেমী যেকেউ সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। গান, কবিতা, আড্ডায় কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যেত টের পাওয়া যেতনা। সেসব অনেকদিন আগের কথা। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী সন্ধ্যাগুলো টের পাওয়া গেলনা।
কিন্তু গত ৮ ই জুন দুর্গাপুরের এ-জোনের কবি লাকী চট্টরাজ ও সমাজসেবী বিজয় চট্টরাজের সৌজন্যে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যার সাক্ষী থাকার সুযোগ পেলেন দুর্গাপুরের একদল সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। চট্টরাজ দম্পতির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জনের বেশি কবি-সাহিত্যিক ফিরিয়ে আনলেন সোনালী অতীতকে।
ঘরোয়া আড্ডায় পুরোপুরি মেলবন্ধন ঘটল শিশু থেকে শুরু করে নবীন ও প্রবীণ প্রজন্মের। নুন্যতম জড়তা ছাড়াই মনের আনন্দে শিশুরা পরিবেশন করল নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি পাঠ। নবীনরা করলেন স্বরচিত কবিতা পাঠ। অন্যদিকে প্রবীণরা ভাবগম্ভীর আলোচনার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উজার করে দিলেন। বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান করলেন নবীন প্রতিভাদের। সবার মিলিত উচ্ছ্বাসে গম্ভীরতার মুখোশ ফেলে প্রবীণরাও ফিরে গেলেন শৈশবে। হয়ে উঠলেন শিশু। সত্যিই এযেন কৃত্রিমতাহীন অতীতের একঝলক।
এই সুর ধরা পড়ল কবি কাকলী ধারার বক্তব্যের মধ্যে। তিনি বললেন – এমন পরিবেশ মনকে আনন্দ দেয়। নিজের ভাললাগা, ইচ্ছে ভাগ করে নিতে মন চায়। পারদর্শিতা সেখানে মুখ্য হয়না, সমমনস্কতা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রঘুনাথ সিনহা, জয়ন্ত দত্ত, মালতি মণ্ডল, প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল, অন্তরা সিংহরায়, কাকলি ধারা, চুমকি চক্রবর্তী, অনিন্দিতা ব্যানার্জ্জী, শান্তনু ভট্টাচার্য, অনন্যা ভট্টাচার্য প্রমুখ। দুর্গাপুরের বুকে এরা প্রত্যেকেই সুপরিচিত কবি-সাহিত্যিক। সঙ্গে শিশু শিল্পী প্রিয়দর্শিনী, অভিজ্ঞান, হৃতিকাদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মত।
প্রত্যেকেই চট্টরাজ দম্পতির এই মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান এবং আগামী দিনেও যাতে দুর্গাপুরের বুকে এই ধরনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আরও বেশি করে আয়োজন করা যায় তার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
উপস্থিত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লাকী দেবী বললেন – বর্তমানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাহিত্যচর্চার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করার চেষ্টা করলাম। এটা ঠিক, এখানে নিজের অর্থ দিয়ে কেনা মেমেণ্টো বা উত্তরীয় নাই, কিন্তু আছে প্রাণের আবেগ মনের টান। এটাই তো বাংলা সাহিত্যচর্চার আবহমানকালের ঐতিহ্য।