মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- আশঙ্কাই সত্যি হল। ‘প্রচেষ্টা’র সামনে এসেই থমকে গেল এডিডিএ’র বুলডোজার। টানা পাঁচ ঘন্টা হাঁটুমুড়ে মুখ থুবড়ে বসেই রইলো পথে। কাঁধে কাঁদানে গ্যাস-গান, হাতে লাঠি, কোমরে পিস্তল গুঁজে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এডিডিএ’র ‘পরাজয় দৃশ্য’ তারিয়ে তারিয়ে দেখল পুলিশ। ঘড়ি ধরে সময়সীমা পার করে প্রায় ৪০ জনের বাহিনী নিয়ে আসা পুলিশ অফিসাররা ঘোষণা করলেন, “সময় শেষ। এবার তো ফিরতে হবে। চলুন।” ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে জবরদখল উচ্ছেদে আসা এডিডিএ’র টাউন প্ল্যানার সৌরভ খান বললেন, “ওপর মহলের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকলাম তো অনেকক্ষণই। কিন্তু, কোনো অর্ডার না আসায় এবার চলে যেতে হচ্ছে।” প্রশ্ন উঠছে, এডিডিএ’র চেয়ারম্যান নিজে যখন বারে বারে ঘোষণা করছেন, “লাল দাগ চিহ্নিত অবৈধ সমস্ত নির্মাণ ভাঙতেই হবে”, তারপরও আবার কার নির্দেশের অপেক্ষায় দিনভর প্রচেষ্টা ক্লাবের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে এমন একটি নাটক কেনই বা করলো পুলিশ আর এডিডিএ’র বাহিনী ? তবে কি তাদেরকে রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন অন্য কেউ ?
দু সপ্তাহ ধরে সিটি সেন্টার জুড়ে অবৈধ জবরদখল উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে আসানসোল দূর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)। সেই অভিযানে সিটি সেন্টারের জংশন মল, সিটি ক্লাব মোড়, মোর শপিং মল এলাকায় ফুটপাতের ওপর ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করা বেকার যুবকদের দোকান ঘর ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে এডিডিএ’র বুলডোজার। কিন্তু, বাহুবলী সেই বুলডোজার বারে বারে প্রচেষ্টা ক্লাব চৌহদ্দি পোঁছানোর আগেই মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। এডিডিএ সূত্রে জানা যায়, সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান কবি দত্তই নাকি বারে বারে প্রভাব বিস্তার করে বুলডোজারের কামড় থেকে বাঁচিয়েছেন এই প্রচেষ্টা’কে। ক্লাবটির মান ইজ্জত বাঁচাতে সিটি সেন্টারের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা উজ্জ্বল মুখার্জিও দরবার করেছেন চেয়ারম্যানের কাছে। এছাড়াও, রবিবার কবি দত্ত এডিডিএ গেস্ট হাউসে গোপন বৈঠক করেছেন মন্ত্রী মলয় ঘটকের সাথে। তারপরেও মঙ্গলবার এডিডিএ’র বুলডোজার পুলিশি বেষ্টনী সাথে নিয়ে পৌঁছে যায় বিতর্কিত বিলাসবহুল ক্লাব ঘরটির দোড়গোড়ায়। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। ‘ধনীর দুলাল’দের ক্লাব ঘর ভাঙ্গার দৃশ্য দেখতে পথ চলতি মানুষজন দাঁড়িয়ে পড়েন। ছুটে আসেন যে সব হকারের দোকান ঘর, হোটেল ইতিমধ্যেই ভাঙ্গা হয়েছে সেই বুভুক্ষু বেকার বাহিনীও প্রচেষ্টা চত্বরে। তাদেরই একজন অখিল শীহি বলেন “আমাদের দোকানপাট তো সহজেই ভেঙে দিল আর এই বড়লোকদের ছেলেদের ক্লাবঘর ভাঙতে ওদের এত গড়িমসি কেন ?”
কেন গড়িমসি? এডিডিএ’র হয়ে যেন সাফাই দিলেন ক্লাবের উৎসাহী সদস্যরাই। বললেন, শাসকদলের জেলা সভাপতি নরেন চক্রবর্তী নাকি ক্লাব ভাঙতে বারণ করে দিয়েছেন। ওদের কথায়, “নরেনদা আমাদেরকে বলেছে তোরা ক্লাবের ভেতরে বসে যাবি। পুলিশ ধস্তাধস্তি করলে আমায় জানাবি। তারপর বুঝে নেব আমি।” একটা আপাদমস্তক তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী জবরদখলকারী ক্লাবকে বাঁচাতে নরেনের এত দায় কেন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নরেন বলেন, “ওসব একেবারেই ফালতু কথা। ওই ক্লাবটা ঠিক কোথায় আমি জানিইনা। ওরা এসেছিল আমার কাছে আমি সাফ বলে দিয়েছি সরকারি কাজে শুধু শুধু কেন আমি হস্তক্ষেপ করতে যাব? ওরা ইচ্ছে করে এসব গল্প বাজারে ছড়াচ্ছে। ওসব ব্যাপারে আমি একদম নেই।” তাহলে ? এডিডিএ’র সূত্র জানাচ্ছে, কবি মন্ত্রী মলয়ের সাথে গোপন বৈঠক করার ৪৮ ঘন্টা পরেও মন্ত্রী নাকি বিষয়টি নিয়ে কোন সুপারিশ বা তদবির কিছুই করেননি ক্লাব নিয়ে।
অর্থাৎ, নরেন, মলয় নন। তাহলে কি ফের সেই কবি দত্তই ? মঙ্গলবার থমকে যাওয়া অভিযানের মাঝেই বিজেপি নেতা জিতেন্দ্র তিওয়ারি অন্য একটি অনুষ্ঠানের মাঝে বিনা কারণেই প্রচেষ্টা প্রসঙ্গ টেনে কবি দত্তর হয়ে হঠাতই সাফাই দিতে শুরু করে বলে বসেন, “কবি দত্ত ভুল কি করেছে? তাপস ব্যানার্জীর ক্ষমতা থাকলে এসব অভিযান আসানসোলে করে দেখান! অযথা দুর্গাপুরে অশান্তি সৃষ্টি করছেন কেন ?” কবি দত্তর হোটেলে তাপস ব্যানার্জিকে কখনো দেখা যায়নি বটে, তবে জিতেন্দ্র কে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। তাই কি কবিকে বাঁচাতে জিতেনের আসরে নামা, নাকি প্রচেষ্টা বাঁচাতেই তার এই কৌশল ? তবে কি তৃণমূলের অভিযোগটাই সঠিক, যে প্রচেষ্টা ক্লাবটি বিরোধী দলের একটি ঘাঁটি ? কারণ, এদিন বারে বারে প্রচেষ্টার ছেলেরা অজুহাত তুলেছে অল্প দূরেই তৃণমূলের পার্টি অফিস না ভেঙ্গে ক্লাব ভাঙ্গা হচ্ছে কেন ? তাহলে কি প্রচেষ্টা ক্লাব একটা অন্য দলের দলীয় কার্যালয়? জিতেনেরই দলের? প্রচেষ্টার পার্টি অফিস প্রসঙ্গ টেনে আনার পর এডিডিএ’ র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূলের পার্টি অফিসটা আমাদের জমিতে নয়। ওটা হাউসিং বোর্ডের জমি। ওটা আমাদের এরিয়াতে পড়ে না। আমরা ভাঙতে যাব কেন ?” এই তাপসই কিন্তু সিটি সেন্টার, বিধান নগরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিলেন তৃণমূলের পার্টি অফিস ভেঙে। সেই ২০১২তে। মঙ্গঁলবার তিনি পরিষ্কার জানান, “আজ যারা সরকারি কাজে বাধা দিল, তাদের চিহ্নিত করে আমরা কোন রাজনৈতিক রং না দেখেই তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় এফআইআর করছি।”
প্রচেষ্টা ক্লাব শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গা গেল না তিনবারের প্রচেষ্টাতেও। এতে এডিডএ’র কর্মীদের একাংশের মনোবলে যেমন ধাক্কা লেগেছে। তেমনি হতাশ শাসকদলের অন্ধরেও। আবার হাওতাশ করেছেন সিটি সেন্টারের ফুটপাতের হকারেরা। ক্লাবের পক্ষে সভাপতি হরকালি পাঁজা প্রচেষ্টাকে মন্দির, মসজিদের সাথে তুলনা করে দাবি করেন, “প্রচেষ্টা ভাঙতে হলে মন্দির, মসজিদ সবই ভাঙ্গা উচিৎ। আমরা সমাজসেবী সংগঠন। আমাদের উপর এ আঘাত মেনে নেব না।” পেশায় ঠিকাদার হরকালির মন্তব্যে মুচকি হেসেছেন সিটি সেন্টারের আমজনতা। কারো কারো মন্তব্য, “ধনীর দুলালদের শুঁড়িখানাও তবে মন্দির, মসজিদ, গির্জার সমান ? বা!”
এদিকে এডিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ছিন্নমূল হকারদের জন্য সদার্থক চিন্তাভাবনা রয়েছে সংস্থার। বিধাননগরে উচ্ছেদ হওয়া হকারদের জন্য যেমন ৪০টি আর বিশ্বকর্মা নগরে ১৮টি দোকানঘর বানিয়ে দিয়েছে এডিডিএ, সিটি সেন্টারেও ঠিক তেমনিই পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।