জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- গত কয়েকদিন ধরে বঙ্গের তাপমাত্রা উর্দ্ধমুখী। আরও বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তরের বোর্ড দেখলে মনে হবে আইপিএল খেলা চলছে। টি-২০ ক্রিকেট ম্যাচের মত তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে- ৩৮°, ৩৯°, ৪০°, ৪২°…. থামার কোনো লক্ষণ নাই। এখানে বসেই মরু অঞ্চলের অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে। সমাজ মাধ্যমে প্রকাশিত ‘মিম’-এ শহরের বুকে উট দ্যাখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক জনজীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা সাময়িক রেহাই পাওয়ার উপায় বাতলে দিলেও দীর্ঘমেয়াদী উপশমের কোনো ইঙ্গিত নাই।
যারা তাপমাত্রার উর্দ্ধগতি থামাতে পারত- রাস্তা সম্প্রসারণের নামে সেই বৃক্ষরূপী বোলারগুলো কোথায় হারিয়ে গ্যালো। গৃহহীন হলো হাজার হাজার পাখি। রাস্তার ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইলো তাদের সাধের বাসা। পথচলতি মানুষ চলার পথে হারালো গাছের ছায়ার নীচে ক্ষণিকের বিশ্রামের সুযোগ। জাতীয় সড়ক থেকে শুরু করে রাজ্য সড়ক সর্বত্রই একই দৃশ্য। দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে, এনএইচ-২ বি – রাস্তার দু’ধার বৃক্ষ শূন্য। খাঁ খাঁ করছে। পরিবেশ ধ্বংস করে কাদের স্বার্থে এই রাস্তা সম্প্রসারণ? ফোর লেনটা সিক্স লেন অথবা টু লেনটা ফোর লেন করার কি খুবই দরকার আছে? বেগের লড়াই তো আবেগ কেড়ে নিচ্ছে! ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ শব্দটা মানুষের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসছে। এখনো সচেতন নাহলে পরিণতি কিন্তু ভয়ংকর! আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য কিছুই থাকবেনা।
অন্যদিকে আছে মানুষের সীমাহীন লোভ ও অজ্ঞতা। বনে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বর্বর উল্লাসে ফেটে পড়ছে একদল মানুষ। বনের পশুপাখি সহ অন্যান্য অবলা প্রাণীগুলোকে আগুনে পুড়তে দেখে সেকি পৈশাচিক আনন্দ। রাতের অন্ধকারে ক্ষেত জমিতে পড়ে থাকা ফসলের শেষাংশে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দূর থেকে দেখলে মনে হবে গণ শবদাহ চলছে। কখনো কখনো জমির ধারে বা জলা জমির গায়ে লেগে থাকা শুকনো বেনাগাছে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মাঝে মাঝে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া যায় আউসগ্রামের জঙ্গলে অথবা অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলে। পরিণতির কথা না ভেবে অজ্ঞ আদিবাসীরা যখন শিকারের আশায় জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয় তখন তাদের বুঝিয়ে হয়তো সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু যখন জমি মাফিয়ারা বা কর্পোরেট সেক্টরগুলো সেই কাজ করে তখন তাদের কে সামলাবে? পরিবেশ নয় তাদের তো একটাই লক্ষ্য আরও আয়। তাতে কে বাঁচল বা কার ক্ষতি হলো সেটা ভাববার সময় তাদের কোথায়?
শুধু কি তাই, মাঝে মাঝে শোনা যায় শাসকদলের একশ্রেণির নেতা নাকি বিভিন্ন এলাকার জঙ্গলের গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গেলেই লালচক্ষু নেমে আসছে প্রতিবাদকারীর উপর। খবর করতে গিয়ে সাংবাদিকদেরও নাকি হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।
মাঝে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করা হয় ঠিকই কিন্তু তার শেষ পরিণতি কি হয়? বছর খানেক আগে এই রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন রাস্তার ধারে গাছ বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখন রাস্তার ধারে ক’টা গাছ দ্যাখা যায়? হয়তো খোঁজ নিলে দ্যাখা যাবে গাছগুলো পরিচর্যার জন্য রাখা অর্থ স্থানীয় নেতাদের পকেটে ঢুকে গ্যাছে। তবে এটা শুধু এই আমলে নয়- শোনা যায় কয়েক বছর আগে বাম আমলে একইভাবে গাছ পরিচর্যার অর্থ নাকি কোনো সিপিএম নেত্রীর আঁচলে বাঁধা হয়ে যায়।
কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলো বাজেট পেশ করে। কেউ কি বলতে পারবেন কোনো সরকার গাছ লাগানোর জন্য পৃথকভাবে বাজেটে নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ করেছে? সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রায় বারো হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি বা মেরামতের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে। খুব ভাল সিদ্ধান্ত। কিন্তু কোনো অর্থ কি গাছ লাগানোর জন্য বরাদ্দ করেছে?
অথচ জাতীয় ও রাজ্য সড়ক, গ্রামীণ রাস্তা, নদী ও সেচখালের দু’ধারে প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। অনেক পতিত জায়গা পড়ে আছে। পরিবেশের স্বার্থে সহজেই সেখানে বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে। দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তে সেগুলো পরিচর্যার দায়িত্ব স্থানীয় ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে দেওয়া যেতেই পারে। পরে যখন গাছগুলো বিক্রি করা হবে তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে। সঙ্গে নতুন করে গাছ লাগানোর শর্ত অবশ্যই থাকবে। তবে সব গাছ একসঙ্গে কাটলে হবেনা।
কথা হচ্ছিল হুগলির পরিবেশ কর্মী সোমা দাসের সঙ্গে। তিনি বললেন – আমাদের সাধ্যমতো আমরা ছোট করে পরিবেশের সেবা করার চেষ্টা করি। এটুকু বুঝতে পারছি প্রত্যেকেই যদি অন্তত নিজ নিজ জায়গায় একটা গাছ লাগায় এবং যথাযথ পরিচর্যা করে তাহলে পরিবেশ অনেকটা সুরক্ষিত থাকবে।