সংবাদদাতা,বাঁকুড়াঃ- এবার জাতীয় শিক্ষক হিসাবে সম্মান পেতে চলেছেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক প্রাথমিক শিক্ষক বুদ্ধদেব দত্ত। রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ প্রাপক বুদ্ধদেব দত্ত বাঁকুড়ার জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক । কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবার এরাজ্য থেকে তিনিই একমাত্র এই পুরস্কার পাচ্ছেন। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে।
তবে এই সম্মান সহজে আসেনি। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে নাই রাজ্যে মূলত স্রোতের বিপরীতে হেঁটে ও প্রচুর পরিশ্রমই তাঁকে এই সম্মান এনে দিয়েছে বলে মনে করেন বুদ্ধবাবু। স্কুলে যাই পড়াই মাইনে পাই গোছের শিক্ষকতায় তিনি কোনওদিন বিশ্বাসী নন। বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ ও প্রকৃতি প্রেম জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষণ পদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের মতো নতুন নতুন পদ্ধিতে শিক্ষাদান নিয়ে সবসময় সচেষ্ট থাকেন তিনি।
প্রসঙ্গত ছোট বেলায় এই জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশুনা করেছেন বাঁকুড়ার জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা বুদ্ধদেববাবু। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে বিষ্ণুপুরের দেউলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহ শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দেন। এরপর বিভিন্ন স্কুল ঘুরে ২০১২ সালে সহ শিক্ষক হিসাবে গ্রামের জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। নিজে যে স্কুলে শৈশব কেটেছে সেই স্কুলে শিক্ষক হিসাবে ফিরে এসে স্কুলকেই ধ্যানজ্ঞান করে তোলেন বুদ্ধদেব বাবু। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্যদের সহযোগীতায় স্কুলের পরিবেশই আমূল বদলে ফেলেন তিনি। স্কুলের ক্লাসরুমের দেওয়াল গুলিকে বিভিন্ন পাঠ্য বিষয়ের ছবি ও পাঠ্য বিষয় দিয়ে রঙিন ও শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলেন। বই-খাতা ছাড়া ক্লাসরুমে অনায়াসে পড়াশোনা করতে পারে পড়ুয়ারা। স্কুলের সীমানা পাঁচিলেও ফুটিয়ে তোলেন নানা মূল্যবোধ ও প্রকৃতি প্রেমের দুর্দান্ত সব রঙিন ছবি ও বার্তা। স্কুলের সমস্ত পাঠ্য বইকে বার কোডে রুপান্তরিত করে স্কুলের দেওয়াল ও গেটে সেই বারকোড এঁকে দেন যাতে যে কোনো অভিভাবক নিজের ফোনে বারকোড স্ক্যান করে অনায়াসেই পেয়ে যেতে পারেন যাবতীয় পাঠ্য সূচী। করোনাকালে যখন সমস্ত মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছিলেন সেই সময় বুদ্ধদেব বাবু অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি স্কুলের প্রতিটি পড়ুয়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বুঝিয়ে দিয়েছেন বই এর পড়া, নিয়ম মেনে করেছেন পড়ুয়ায়দের মূল্যায়ন। তবে তাঁর শিক্ষা শুধু পড়ার বইয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে তাই নয়। তাঁর চেষ্টায় স্কুলের পড়ুয়াদের মধ্যে তৈরি হয়েছে পড়ার বইয়ের বাইরে গল্প, বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বদের জীবনী সহ বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার ঝোঁক। স্কুলের পড়ুয়াদের লেখাপড়া শুধুমাত্র ক্লাসরুমে সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁদের নিয়ে কখনো বুদ্ধদেব বাবু গেছেন স্থানীয় জঙ্গলে আবার কখনো স্থানীয় প্রাচীন মন্দিরে। হাতে কলমে তাদের চিনিয়ে দিয়েছেন গাছ, গাছালি, পশু পাখি। বুঝিয়ে দিয়েছেন ইতিহাস, স্থাপত্য, ভাস্কর্যর হাল হকিকৎ ।
তাঁর এই শিক্ষণ পদ্ধতি মন কাড়ে নির্বাচকদের। ২০২০ সালে রাজ্য সরকারের শিক্ষারত্ন পুরস্কার পান বুদ্ধদেব দত্ত। এবার জাতীয় শিক্ষক হিসাবেও তাঁর নাম নির্বাচিত হয়। বুদ্ধদেববাবুর এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবর জানাজানি হতেই খুশির হাওয়া জয়পুর প্রাথমিক স্কুলে। প্রধান শিক্ষক উজ্জ্বলকুমার পরামানিক বলেন, বুদ্ধদেববাবুর কৃতিত্বে আমরা গর্বিত। সারা দেশ আমাদের স্কুলের নাম জানতে পারবে। এটা কি কম পাওয়া? অন্যদিকে বুদ্ধদেববাবুর দাবী এই পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর দায়িত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিল।