নিজস্ব সংবাদদাতা, বর্ধমান: দুর্গাপুরের পর এবার বর্ধমান। কিন্তু, সেই পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক। অপরাধের ধরনও একই। তিনটি চেকের পাতায় পুরসভার ঘরে, অথচ সেই চেকের দুটি ভাঙ্গিয়ে ১.৪৩ কোটি টাকা তুলে উধাও হলো মুম্বাইয়ের সাইবার অপরাধীরা। মাথায় হাত পুরসভার, অথৈ জলে পুলিশ। হতভম্ব ব্যাঙ্ক।
চাঞ্চল্যকর এই প্রতারণার বিষয়ে যেটুকু জানাগেছে – দু দফায় ওই ১.৪৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর, দুষ্কৃতীরা তৃতীয় দফায় ৯৭.৫২ লক্ষ টাকা হাতাতে গেলে টনক নড়ল বর্ধমান পৌরসভা কর্তৃপক্ষের। এই ৯৭ লক্ষাধিক টাকার চেক আটকে দিতেই হদিশ মিলল যে ইতিমধ্যেই দুষ্কৃতিরা দুটি চেকের মাধ্যমে পৌরসভার ১.৪৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সূদূর মহারাষ্ট্রের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের একটি শাখা থেকে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার বর্ধমান পৌরসভার একাউন্ট থেকে টাকা গায়েব হওয়ার এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় পৌর সভার পক্ষ থেকে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্ট থেকেও গত দেড় বছরে কয়েক দফায় রহস্যজনক ভাবে কয়েক কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই ঘটনার তদন্ত এখনো চলছে। সেই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মী সহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছেন। তারা সকলেই এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, বর্ধমান পৌরসভার এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই পুলিশ মহারাষ্ট্রে তদন্তের জন্য রওনা দিয়েছে। জানা গেছে, ১.৪৩ কোটি টাকা পৌরসভার একাউন্ট থেকে যে তোলা হয়েছে এই বিষয়টি গত শনিবারই পৌরসভা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে। পুরসভার হিসাবরক্ষক সুভাষ কর্মকার জানিয়েছেন, বর্ধমানের পিএনবি ব্রাঞ্চ থেকে তারা জানতে পারেন, গত শুক্রবার মুম্বাই শাখা থেকে এই ব্রাঞ্চে ৯৭ লক্ষ টাকা পেমেণ্টের বিষয়ে জানতে চায়। তখনই বিষয়টি নজরে আসে। কোনো এক কনক জুয়েলার্সের নামে ওই ৯৭ লক্ষ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। সুভাষবাবু জানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীর সাইবার ক্রাইমে জানান। রবিবার বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। বর্ধমান পৌরসভার পাশেই একটি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শাখায় বর্ধমান পৌরসভার একাউন্ট আছে। সেই একাউন্ট থেকেই এই টাকা গায়েব হয়েছে। ব্যাঙ্কটির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সুদীপ্ত ঘোষ বলেন, “পৌরসভার একাউন্ট আছে আমাদের শাখায়। এখান থেকেই টাকা উঠেছে। তবে গোটা বিষয়টি হয়েছে মুম্বাই থেকে। ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। মনে করা হচ্ছে চেক ক্লোন করেই টাকা তোলা হয়েছে।” পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, চেক দুটি পৌরসভাতেই আছে। অথচ তাজ্জব ভাবেই একাউন্ট থেকে টাকা উঠে গেছে। পৌরসভার চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র সরকার বলেন, “আমরা থানায় অভিযোগ করেছি। পুলিশ তদন্ত করছে। আমাদের একটি ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে ১ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা গায়েব হয়ে গেছে। এই ঘটনায় পুরসভার কোন দোষ মেলেনি। যা হয়েছে ব্যাঙ্কের শাখা থেকেই হয়েছে বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস।” পরেশ আরো দাবি করেন, “ব্যাঙ্কে পুরসভার একাউন্ট থেকে টাকা তোলার সময়, নিয়ম অনুযায়ী পুরসভার ফাইন্যান্স অফিসার এবং এক্সিকিউটিভ অফিসারের সই থাকে। এখানে চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানের সই থাকে না।ব্যাঙ্ক ঠিক মত সই না মিলিয়ে টাকা দিয়েছে। এর দায় ব্যাঙ্কের।” সুভাষ কর্মকার জানিয়েছেন, প্রথমে ৬ আগষ্ট ৪৮ লক্ষ ২১ হাজার টাকা এবং পরে ৪ সেপ্টেম্বর ৯৫ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। ক্লোন করা ওই চেকে পৌরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং পুরপ্রধানের সই জাল করা হয়েছে। সুভাষবাবু জানিয়েছেন, এব্যাপারে এখনও পর্যন্ত তাদের ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যে টাকা গায়েব হয়েছে সেই টাকা ব্যাঙ্কই ফেরত আনবে। দুষ্কৃতিরা ওই টাকা তুলে তা অন্য দুটি ব্যাঙ্কের একাউণ্ট ঘুরে একটি নির্দিষ্ট একাউণ্টে রেখেছে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যেই সেই একাউণ্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং এব্যাপারে ২জনকে সেখানকার পুলিশ আটকও করেছে বলে জানা গেছে।
জেলা পুলিশ সুপার আমনদীপ সিং জানিয়েছেন, “বর্ধমান থানায় একটি অভিযোগ হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।” উল্লেখ্য, মাত্র দুসপ্তাহ আগে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকেরই দুর্গাপুর শহরের সিটিসেন্টার ব্রাঞ্চ থেকে স্বাগতা তিওয়ারি মুখার্জী নামে দীর্ঘদিনের এক গ্রাহকের একাউন্ট থেকে এভাবেই চেক জাল করে এক দুষ্কৃতী ব্যাংকের ভেতরেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারটি চেকের পাতা নষ্ট করে স্বাগতার একাউন্ট থেকে ১.৫০ লাখ টাকা তুলে উধাও হয়ে যায়, যার খোঁজ এখনো পায়নি পুলিস। স্বাগতার চেকবইটি কিন্তু টাকা লুঠের সময়েও ব্যাংকের হেফাজতেই ছিল। সোমবার তাদের সাসপেন্স একাউন্ট থেকে স্বাগতাকে তাদের লুঠের সমপরিমাণ টাকা মিটিয়ে দিলেও, সরষের মধ্যে ভূতের সন্ধান এখনও পায়নি পুলিশ বা ব্যাংক কেউই। দুর্গাপুরের লুঠের তদন্তে রয়েছে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের সাইবার ক্রাইম শাখা। এরই মধ্যে একই কায়দায় ফের ওই ব্যাংকেরই বর্ধমান শাখায় চেক জালিয়াতি করে লুঠের ঘটনায় ওই ব্যাংকের কাজ কারবার এখন গ্রাহকদের সন্দেহের তালিকায়।