সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- সৃষ্টিকর্তা রূপে ব্রহ্মা পরিচিতি পেয়েছেন, অন্যদিকে পালন করেন বিষ্ণু এবং সংহার করেন মহাদেব। এই তিন শক্তির মধ্যে এক সময় ব্রহ্মার মধ্যে অহং বোধ সৃষ্টি হয়। তিনি অহংকারবশত মনে করেন এই পৃথিবীতে যা কিছু তা তিনি সৃষ্টি করছেন। তখন এক একটি পুরাণ অনুযায়ী এক এক ভাবে ব্রহ্মার অহংকার কে চূর্ণ করা হয়। শৈব পুরাণ গুলি বলে দেবাদিদেব মহাদেবের অনাদি লিঙ্গ দর্শন করে ব্রহ্মার অহংকার চূর্ণ হয়েছিল আবার বৈষ্ণব পুরাণ গুলিতে বলা হয় , ভগবান নারায়ণ স্বয়ং নিজের সৃষ্টি করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সৃষ্টি তিনি করেন, এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মা ক্ষমা চান। শ্রীমদ্দেবীভাগবত মহাপুরাণের তৃতীয় স্কন্ধ অনুযায়ী ব্রহ্মা বুঝতে পেরেছিলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বর কিচ্ছু নয় সমস্ত কিছুই আদি শক্তি মহামায়ার নির্দেশে হচ্ছে। মহামায়া স্বয়ং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কে তৈরি করেছেন সেখানে তিনি কে যে সৃষ্টি করবেন? দেবীভাগবতে আছে ব্রহ্মা যখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন তখন তিনি দেবীর দীর্ঘ স্তব করেন। চতুর্থী তিথি থেকে দুর্গা নবমীর তিথি পর্যন্ত কেউ যদি সেই স্তব ভক্তিপূর্ণ ভাবে পাঠ করেন তবে অবশ্যই দেবীর কৃপা লাভ করবেন।
দেবীভাগবত অনুযায়ী বলা হচ্ছে, সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা বলছেন “ জননি! বেদ সকল আপনার তত্ত্ব জানিতে পটু নহে এমন নয়, যেহেতু যজ্ঞাদি ক্ষুদ্রকর্ম্মে সর্ব্বজনবিধাত্রী ও নিষ্কল অর্থাৎ পূর্ণরূপিণী আপনার উল্লেখ না করিয়া ইন্দ্রাদি অপ্রধান দেবতাগণেরই উল্লেখ করিয়াছেন এবং ত্বদীয় অংশভূত স্বাহাদেবীকে হোমযজ্ঞাদি কার্য্যের বিধাত্রীরূপে বিধান করিয়াছেন; অতএব, দেবি! আপনি এই অখিল ভুবন মধ্যে চৈতন্য-রূপিণী, সর্ব্বজ্ঞা এবং দেবাদি-সমন্বিত সমস্ত লোকের অতীত বলিয়া প্রতিপাদিত হইতেছেন। দেবি! আমি এই অতিশয় অদ্ভুত সর্ব্ব চরাচর সমন্বিত অখিল ব্রহ্মাণ্ড মণ্ডলের সৃষ্টি করিয়াছি, অতএব আমি এই অখিলের কর্তা, এই চরাচর ত্রিভুবনে আমার তুল্য ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ আর কে আছে? আমি সর্ব্বলোকাতীত ব্রহ্মা এইরূপ গর্ব্বের কারণ বশতই আমি এই অতি বিস্তৃত সংসারসাগরে নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছি। পরন্তু, জননি! এখন আমি আপনার পাদপঙ্কজের পরাগগ্রহণগর্ব্বে যথার্থই ধন্য হইয়াছি এবং আপনার প্রসাদে যথার্থই স্বরূপবক্তা হইয়াছি। মাতঃ! আপনার নিকট এই প্রার্থনা যে, আপনি আমার এই মোহজালপ্রসূত মহাদুঃখময় নিগড় অপনয়ন করিয়া আমাকে আপনার প্রতি ভক্তিযুক্ত করুন। মাতঃ শিবে! আমি আপনার আবিষ্কৃত পদ্ম হইতে জন্মলাভ করিয়া, এক্ষণে কি প্রকারে মুক্তিলাভ করিব এইরূপ, চিন্তাকুলিত চিত্তে ভবার্ণবে মোহদ্বারা নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছি, আপনি আমাকে আপনার আজ্ঞাবহ কিঙ্কর নিশ্চয় করিয়া সেই দুস্তর সাগর হইতে পরিত্রাণ করুন । জননি! যাহারা আপনার পবিত্র চরিতগাথা, অবগত নহে, তাহারাই আমাকে এই জগতের প্রভু বলিয়া মনে করে, আর যাহারা আপনার প্রভাব বিদিত নহে তাহারাই স্বর্গকামনায় যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। মাতঃ শিবে! আপনি সনাতনী মহা-মায়া, আপনি সংসার সৃষ্টি প্রভৃতি লীলা করিবার নিমিত্ত আমাকে বিধাতৃপদে অভিষিক্ত করিবার জন্য উৎপাদন করিলে আমি স্বেদজ, অগুজ, জরায়ুজ ও উদ্ভিজ্জ এই চারিপ্রকার জীব সৃষ্টি করিয়া “আমিই সকল জানি অন্য কেহই আমা অপেক্ষা অধিক অবগত নহে” এই অহঙ্কারে অহঙ্কৃত হইয়া যে অপরাধ করিয়াছি তাহা আপনি ক্ষমা করুন। মাতঃ! জগদম্বিকে! আপনিই হরিকে এই অখিল লোকের পার্লন কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। আপনি জগৎসংহারক হরকে দিয়ে যথাকালে সংহার করেন, আপনি আদ্যা ও অদ্বিতীয়া সনাতনী শক্তি, অতএব কেহই আপনার তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে অবগত হইতে পারে না। অম্বিকে! আমি আপনার সহায় বলেই সৃষ্টি করিতে সমর্থ হই, হরি এবং হরও সেইরূপ আপনার প্রভাবেই পালন ও সংহার করিতে সমর্থ হইয়া থাকেন। আপনার আশ্রয় ব্যতীত আমরা ঐ সকল কার্য্য সম্পাদন কারতে কদাচই সমর্থ নহি। জননি! আপনার আশ্চর্য্যজনক লীলা ব্যাপারে অদূরদর্শী পণ্ডিতগণে যে পরস্পর বিবাদ করিবে ইহাতে আর বিচিত্র কি? আপনি “একমেবাদ্বিতীয়ম্”। জননি! আপনি কৃপাপূর্বক আমাকে বিস্তার পূর্ব্বক আপনার স্বরূপ সম্পর্কে বলুন, তাহা হইলেই আমি পরমা-শক্তিকে অবগত হইয়া সংসার সাগর হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিব।“
অর্থাৎ-দেবী আমি অহংবশত নিজেকে সৃষ্টিকর্তা রূপে ভেবেছিলাম কিন্তু পরে বুঝলাম সৃষ্টি, স্থিতি ,প্রলয় সবের মূলে আপনি। হরি,হর সহ আমার নির্মাতা আপনি, এই অখিল ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকারীও আপনি, তাই দেবী আপনি আমার অজ্ঞান দূর করে,আমাকে কৃপা পূর্বক আপনার পাদপদ্ম তলে আশ্রয় দান করুন,কারণ আপনার চরণেই শান্তি ও মোক্ষ দুইই আছে। যে মূঢ় সেই একমাত্র আপনাকে ছেড়ে স্বর্গ কামনা করে।হে দেবী, হে আদ্যাশক্তি, হে মহামায়া, জননী আপনি আমার প্রতি করুনা করুন, কৃপা করুন ও আমাকে ক্ষমা করুন আপনার কৃপাতেই আমি যেন আপনার স্বরূপ বুঝতে পারি ও সংসার রূপ সমুদ্র অতিক্রম করতে পারি।





