জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,কলকাতাঃ- দৌড়ানোর আগে থামতে শিখতে হয়। ঠিক তেমনি শুরু করার আগে কোথায় গিয়ে এবং কখন থামতে হবে সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান থাকতে হয়। নাহলে দিনের শেষে লাভের বদলে ক্ষতির কড়ি গুণতে হবে এবং এটাই অনিবার্য।
তৃণমূলের আমলে প্রায় শুরুতেই উঠল চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারির অভিযোগ। অধিকাংশ চিটফাণ্ড বামফ্রন্টের আমল থেকেই তাদের ব্যবসা শুরু করে। এজেন্টরাও তখন থেকেই যুক্ত। অথচ তার অনেক পরে ‘সারদা’র কোনো একটা সভায় মদন মিত্র উপস্থিত হওয়ায় আঙুল উঠল তার দিকে। বলা হলো তাকে দেখেই নাকি এজেন্টরা সারদায় কাজ করছিল। হাস্যকর অভিযোগ। সিপিএমের নেতারা তো সারদায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। কিন্তু তাদের আমলে সঞ্চয়িতা, ওভারল্যাণ্ড, ফেভারিট সহ বিভিন্ন চিটফাণ্ডের কথা ভুলে গেল। জনগণ কিন্তু টাকা ফেরত পায়নি। কাগজে সিপিএমের নেতাদের সঙ্গে চিটফাণ্ডের কর্তাব্যক্তিদের ছবি প্রকাশিত হলো। মদন মিত্র সহ তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা গ্রেপ্তার হলো এবং জামিনে মুক্ত হলো। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও আজও প্রতারিত মানুষ টাকা ফেরত পেলনা। দায় কার?
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে এল নারদা কেলেঙ্কারি। ক্যামেরার সামনে কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে টাকা নিতে দেখা গেল। কে কি উদ্দেশ্যে টাকা দিল, তার এতে কি লাভ হয়েছিল এবং সরকার বা জনগণের কি ক্ষতি হলো সেটা আজও স্পষ্ট না হলেও সিপিএম সেটাকেই আঁকড়ে ধরল। শ্রেণিশত্রু কংগ্রেসের হাত ধরে বিধানসভা ভোটে অবতীর্ণ হলো। এবারও জনগণ সিপিএমকে বিশ্বাস করতে পারলনা। ফল সবার জানা।
২০২১ সালে বিধানসভার নির্বাচনের আগে ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে কার্যত তৃণমূলের বিপর্যয় ঘটে গেছে। বিজেপির কর্মীরা গোটা রাজ্যজুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। বাংলা দখলের লক্ষ্যে বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচারের ময়দানে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যযাত্রী হয়ে উঠলেন। এই দৃশ্য আগে দেখা যায়নি। নীচু তলার কর্মী এবং সাধারণ মানুষের ভাবাবেগকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আশায় সিপিএম এক ধর্মীয় নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারই দেওয়া শর্তে রাজি হয়ে ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হলো। চৌত্রিশ বছর ধরে রাজত্ব করা একটা দলের কাছে এটা যে বড্ড লজ্জার সেটা এরা বুঝতেই পারলনা। এবারও ভোটের ফল সবার জানা, শূন্য।
আসলে চৌত্রিশ বছর ধরে রাজত্ব করা নেতারা ফিরে আসার জন্য আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হবে সেটা আজও বুঝে উঠতে পারলনা। উল্টে শুরু থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে নেগেটিভ প্রচারে মেতে ওঠে। জনগণ কেন তাদের উপর বারবার ক্ষুব্ধ হচ্ছে সেটা নিয়ে আত্মসমালোচনা করা হলোনা।
দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ধরে একাধিক গণহত্যা হয়েছে এটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। ঘটনার জন্য কারা দায়ি সেটা খুঁজে বার করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব কার ছিল? পাড়ায় পাড়ায় ছোটখাটো হিংসাত্মক ঘটনা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। নিজ নিজ এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছে ডাবলু আনসারি, মজিদ মাস্টার, তপন-সুকুরের মত সম্পদরা। এটা ঠিক এই সম্পদদের অনেকেই আজ তৃণমূল কংগ্রেসে বা কেউ কেউ বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সেদিন কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি? রাজনীতি থেকে পুলিশকে সরিয়ে রাখলে বছরের পর বছর পুলিশের গায়ে ‘দলদাস’ ট্যাগ লাইন লাগত না।
তৃণমূলের জন্য নাকি বিজেপির বৃদ্ধি? ত্রিপুরায় কাদের দুর্বলতার জন্য বিজেপি ক্ষমতায়? অন্য রাজ্যগুলোর কথা বললাম না।
শিক্ষায় নিয়োগ সংক্রান্ত দূর্নীতি নিয়ে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ উঠেছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে আপাতত মন্ত্রী কন্যা অঙ্কিতার পরিবর্তে ববিতা চাকরি পেয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দূর্নীতি স্পষ্ট। বাকিটা শুধু দাবির পর্যায়ে এবং সেটা কতটা সত্য সেটা পরবর্তীকালে জানা যেতে পারে। সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পর এবং আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রথমে অভিষেক ব্যানার্জ্জী ও পরে ব্রাত্য বসুর সাক্ষাতের পর আন্দোলনের তীব্রতা কমে গেছে। আদালতের নির্দেশে সাতাত্তর জন চাকরি পাচ্ছে। বাকিদের কি হবে? স্পষ্ট নয়। অযোগ্যদের থেকে নিজেরা যোগ্য সেটা কিন্তু প্রমাণ করার দায় আন্দোলনকারীদের। যারা চাকরি পেল তারা কিন্তু নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে ফেলেছে।
এই পরিস্থিতিতেও বর্ধমান শহরের বুকে সিপিএমের আইন অমান্য আন্দোলন হয়। মানুষ তাদের হিংসাত্মক কাণ্ড কারখানার তাণ্ডব লীলার ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ দেখল। সেই মুখে গামছা বাঁধা ক্যাডার, রাস্তায় ফেলে পুলিশের উপর আঘাত করা ও তাদের উপর ঢিল ছোড়া, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা- সবই মানুষ দেখল। এত ইঁট, পাথর এলো কোথা থেকে? যতই মমতার নেতৃত্বে বিধানসভা ভাঙচুরের উদাহরণ সামনে আনা হোক – মানুষ এসব পচ্ছন্দ করেনা। করেনা বলেই কয়েকদিন আগেই ট্রেনের দরজা বন্ধ করে বসে থাকা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যদের জনগণ ভাল শিক্ষা দিয়েছে। অতএব ভাঙচুরের রাজনীতি থেকে সাবধান।
সিপিএম এখনো বৃদ্ধতন্ত্রে বিশ্বাসী। অভিজ্ঞদের পাশে থেকে নতুনরা অভিজ্ঞ হবে সেই ধারণা এদের নাই। তাই যেকোনো আন্দোলনের প্রধান মুখ সেই বিমান বসু। দলের মধ্যে মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতারা কি আদৌ স্পেস পাচ্ছে? শতরূপকে তো চ্যানেলে ছাড়া সেভাবে দেখা যায়না। অন্যদিকে তৃণমূলে অনেক যুব সম্প্রদায় সামনের সারিতে। দেবাংশু তো চরম জনপ্রিয়।
সুতরাং ফিরে আসতে হলে ভাঙচুরের পরিবর্তে সিপিএমকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। সেটা কি তারা পারবে? দেওয়ালে কান পাতলেই বোঝা যায় বর্ধমানের ঘটনায় তারা পিছিয়ে গেছে।