জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- ফেসবুক খুললেই গতবছর একটা শব্দ বন্ধনী বারবার সামনে এসে হাজির হতো মোবাইলের পর্দায় – কাকলি ফার্ণিচার। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পথে ঘাটে যেকোনো সিরিয়াস আলোচনার মাঝে জুড়ে দেওয়া হতো শব্দ বন্ধনীটা। হাসির রোল উঠত এবং এভাবেই মাঝপথে থেমে যেত আলোচনা।
ঠিক একইভাবে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনীতির মঞ্চে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ডিসেম্বর ধামাকা’। স্পষ্ট করে না বললেও বিরোধী দলনেতার ইঙ্গিত হয়তো ডিসেম্বরেই তৃণমূল সরকারের পতন ঘটবে। অথবা তৃণমূলের কোনো বড় নেতা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হবে। যতই অভিষেককে নিয়ে মাতামাতি হোকনা কেন এখনো তৃণমূলের সবচেয়ে বড় ভোট ক্যাচার এবং রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীর নাম মমতা ব্যানার্জ্জী। কিন্তু মমতার পরিবর্তে বিরোধীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে অভিষেক। তাহলে কি অভিষেককে গ্রেপ্তার করা হবে? তৃণমূল তো নয়ই, রাজনীতির ক্ষেত্রে সেটা স্বাভাবিক, আপাতত শুভেন্দুর দাবিকে দলের দুই শীর্ষ নেতা সুকান্ত মজুমদার বা দীলিপ ঘোষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছেনা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তারা নাকি বলছেন – যিনি বলেছেন তাকেই জিজ্ঞাসা করুন। শুভেন্দুও ঢোঁক গিলতে শুরু করেছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের একগুচ্ছ তথাকথিত প্রথম সারির ও জনপ্রিয় নেতা দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেয় এবং নির্বাচনে প্রার্থীও হয়। এদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। এদের জনপ্রিয়তা কতটা নিজস্ব ও কতটা মমতার দাক্ষিণ্যে সেটা আলোচনা সাপেক্ষ। এদের নিয়েই বিজেপি এই রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেছিল। নির্বাচনের ফলাফল সবার জানা। এমনকি পুর ভোটেও বিজেপি চূড়ান্ত ব্যর্থ। পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপির অনুকূলে ভাল কিছু হবে বলে মনে হয়না।
বিধানসভা নির্বাচনের ফল বের হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বিজেপি কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। অভিযোগের আঙুল ওঠে তৃণমূলের দিকে। বিজেপি ‘ফ্যাক্ট ফাইণ্ডিং’ টিম পাঠায়। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন রাজ্যপাল বিরূপ মন্তব্য করেন। ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে আদালতে মামলা হয়। সিবিআই তদন্ত শুরু হয়। বিজেপি রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলে। প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও আপাতত সিবিআই তদন্তের চূড়ান্ত ফলাফল সামনে আসেনি। সাধারণ মানুষও সব ভুলে গ্যাছে। বিজেপিও আর এই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলেনা। তারপর এই ‘ডিসেম্বর ধামাকা’-র গল্প। কেউ কেউ বলছেন নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার জন্যই নাকি এই দাবি। হতে পারে!!
২০১৯ এর লোকসভা ভোটে আঠারোটা আসন পাওয়ার পরও বিজেপি এইরাজ্যে সংগঠন গড়ার দিকে কোনো নজরই দেয়নি। শুধু কাগজে বিবৃতি দিয়ে গ্যাছে। এমনকি ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্য নেতৃত্ব আক্রান্ত কর্মীদের পাশেও দাঁড়ায়নি। ২০১৯-২০২১ এই দুই বছর এই রাজ্যে বিজেপির যে দাপট দ্যাখা যাচ্ছিল সেটা পুরোপুরি অস্তমিত। ভাবা হয়েছিল অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার পর বীরভূমে বিজেপি কিছুটা দাপট দেখাবে। সেটাও নাই।
এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। হতে পারে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ এর গল্পের মত ‘ডিসেম্বর ধামাকা’-র গল্প শুনিয়ে হয়তো মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়া বিজেপি কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্যেই এই গল্পটা বাজারে ছাড়া হয়েছে। সবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ চলছে। মাস শেষ হতে এখনো অনেক দেরি। এরমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। আপাতত ‘ডিসেম্বর ধামাকা’ নিয়ে উচ্চবাচ্য হচ্ছেনা। এবার হয়তো ‘ধেড়ে ইঁদুর’ এর গল্প সামনে আসবে। ওদিকে কিছু কিছু জায়গায় সিপিএম ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির দ্বিতীয় স্হান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। সংগঠন বিহীন বিজেপির এটাই হতে চলেছে। গুজরাট বিধানসভার ফলাফলও শেষ রক্ষা করতে পারবেনা। বিপর্যয় রুখতে হলে কেন্দ্রীয় এজেন্সির জুজু দ্যাখানোর পরিবর্তে বিজেপি নেতৃত্বকে মাঠে নামতে হবেই। তার আগে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিভাবে আক্রান্ত দলীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হয়, আন্দোলন করতে হয় সেই পাঠটা মমতা ব্যানার্জ্জীর কাছেই নিতে হবে।