মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- দুই খুদে দাবাড়ুর দুপুর থেকে রাত ৯টা অব্দি মরণপণ টানা লড়াইয়ের সাক্ষী থাকলো দুর্গাপুর। চৌষট্টি ঘরের চলতি বছরের জাতীয় প্রতিযোগিতায় শনিবারের রুদ্ধশ্বাস এই খেলাটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষক গেম চেনজার লড়াই বলে চিহ্নিত হয়ে রইলো।
দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারের সিধু কানু ইনডোর স্টেডিয়ামে টানা চলছে ৩৭ তম জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতা। দেশের ২৯ টি রাজ্য থেকে ১৩ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েদের এই প্রতিযোগিতায় শনিবার রাত্রি অব্দি আটটি রাউন্ড সম্পূর্ণ হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে আগামী ২৩ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই ৩৭ তম জাতীয় ওপেন চেস চ্যাম্পিয়নশিপ।
গত ১৭ তারিখ দুপুরে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতাটির সূচনা হয়। এই ৩৭ তম জাতীয় চেস চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতবর্ষের ২৯ টি রাজ্য থেকে প্রায় ৫০০ এরও বেশি খুদে পড়ুয়া ছেলে ও মেয়েরা এই ৩৭ তম জাতীয় অংশগ্রহণ করছে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা অবধি। এই চ্যাম্পিয়নশিপে শনিবার পঞ্চম দিনে ঠিক বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ শুরু হয় অষ্টম রাউন্ডের খেলা। প্রায় ১৫০ টি টেবিলের খেলা শেষ হয় একের পর এক। বিকেল গড়ে সন্ধ্যা অবধি প্রায় সব টেবিলই ফাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু, ৫ নম্বর টেবিলে তখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। সুদূর কর্ণাটক থেকে আসা ১৩ বছর বয়সী সিদ্ধিনাথ পুঞ্জার সাথে ঝাড়খণ্ডের প্রবাসী বাঙালী অধিরাজ মিত্রের। কর্ণাটকার সিদ্ধিনাথের ন্যাশনাল রেটিং ২০৪২ আর চলতি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তার সাড়ে পাঁচ পয়েন্ট রয়েছে। অন্যদিকে, ঝাড়খণ্ডের প্রবাসী বাঙালী অধিরাজ মিত্রের রয়েছে ১৯১৩ রেটিং, আর সেও সাড়ে পাঁচ পয়েন্ট পেয়ে অষ্টম রাউন্ডে কর্ণাটকার সিদ্ধিনাথের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বসে। যত সময় গড়ায় ততই রোমাঞ্চকর হতে থাকে দুজনের এই পাঁচ নম্বর টেবিলের খেলাটি। এইবারে পাঁচ নম্বর টেবিলের খেলাটি ডিজিটাল বোর্ডে হওয়ার ফলে বিশ্বের বহু মানুষ ওই খেলার ফলাফলের দিকে চোখ রেখেছিলেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ৩৭ তম জাতীয় চেস চ্যাম্পিয়নশিপের সকল বরিষ্ঠ আধিকারিকরা ও আরবীট্রারেরা একত্রিত হয়ে ওই দুই খুদে দাবাড়ুর খেলা দেখতে শুরু করেন। দুজনেরই চোখে মুখে ফুটে ওঠে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব। টানটান উত্তেজনার মধ্যেই নিঃশব্দ কানু সিধু ইনডোর স্টেডিয়ামে সকল উপস্থিত ব্যক্তিগণ রুদ্ধশ্বাসের মুহূর্ত গুনছিলেন। অবশেষে রাত ন’টার কিছু আগে ঝাড়খণ্ডের অধিরাজ মিত্রই জয়ী হল। স্টেডিয়ামের বাইরে তার সমগ্র পরিবার চরম উত্তেজনায় প্রহর গুন ছিলেন এই মুহূর্তটার জন্যই।
এদিন পুরুলিয়ার বলরামপুরের আদি বাসিন্দা অভিরাজ মিত্রের গর্বিত পিতা উত্তম মিত্র ও মা রুনা মিত্র সহ তার মাসি, মেসো ও তাদের একমাত্র কন্যা অধিরাজের এই জয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। এক প্রশ্নের উত্তরে অধিরাজের পিতা-মাতা জানান, “ক্লাস সেভেনের জামশেদপুরের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র অধিরাজ। বর্তমানে তারা সকলেই জামশেদপুরের বাসিন্দা। খুব ছোট বয়স থেকেই অধিরাজের দাবা খেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়। গত ছয় বছর ধরে লাগাতার একের পর এক প্রতিযোগিতা জিতে অভিরাজ এবার ৩৭ তম জাতীয় ১৩ বছর বয়সী চেস্ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম স্থান অধিকার করার আশা নিয়ে দুর্গাপুরে এসেছে।” দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের শান্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সবুজে মোড়া শহর দেখে তারাও অত্যন্ত আনন্দিত।
উত্তমবাবু জানান, দুর্গাপুর সম্বন্ধে তিনি বহু কথা আগে শুনেছিলেন। কিন্তু দুর্গাপুরে এবারে এসে তার দুর্গাপুরের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গিয়েছে। দুর্গাপুরের মানুষজনের মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ তাদের সকল পরিবারবর্গ। আগামী দিনেও যাতে জাতীয় চেস চ্যাম্পিয়নশিপ এই শহরেই অনুষ্ঠিত হয় সেই আশা রাখেন তিনি। গত ৫ দিন ধরে চলা ৩৭ তম জাতীয় চেস্ চ্যাম্পিয়নশিপে আজই প্রথম এত রাত অবধি কোন খেলা চলল। ওই খেলাতে অবশেষে প্রবাসী বাঙালির জয়ে গর্বিত সমগ্র দুর্গাপুরের বাসিন্দারা। অধিরাজ মিত্র ও তার পরিবারবর্গকে সহ সুদূর কর্নাটকে থেকে আশা সিদ্ধিনাথ পুঞ্জার ও তার পরিবারবর্গকে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানান সমগ্র দুর্গাপুরের বাসিন্দারা।
শহরে ক্রশম এই চেস বা দাবা খেলার সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় উৎসাহিত শিল্পাঞ্চলের খুদে দাবারুরাও। এদিন দুর্গাপুরের অন্যতম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ডিএভি মডেল স্কুলের এক খুদে পড়ুয়া ওমনিল জানায়, “দাবা খেললে মনের একাগ্রতা বাড়ে, ফলে পড়াশুনাতেও মনোযোগ বাড়ে। যা পড়ুয়াদের চরিত্র গঠনে সাহায্য় করে। তাই আমরা দাবা খেলাকে আমাদের সব থেকে পছন্দের খেলা হিসেবে বেছে নিয়েছি। আগামী দিনে আমরা দুর্গাপুরে আবারো জাতীয় স্তরের বড় টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পাবো ভেবে গর্বিত হচ্ছি।”