মনোজ সিংহ ,দুর্গাপুর: দেশের ৭৬তম গণতন্ত্র দিবসের মুখেই কিক-বক্সিং প্রতিযোগিতার নামে টানা দুদিন ধরে শিল্পশহর দুর্গাপুর জুড়ে দেশের জাতীয় প্রতীক নিয়ে ছিনিমিনি খেললো বেসরকারি একটি ক্রীড়া সংস্থা আর তাদের মঞ্চ আলো করে বসে রইলেন শহরের পুলিশ প্রধান, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রধান,জাতীয় শিক্ষক,সমাজসেবী চিকিৎসক,তৃণমূল নেতা থেকে শুরু করে দুর্গাপুরের মহানাগরিক। কে নেই সেই তালিকায় ? এইসব দায়িত্বশীল আধিকারিকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোস মেজাজে উপভোগ করলেন কিক-বক্সিং। কিন্তু, তারা টেরও পেলেন না বক্সিং খেলায়, খেলার ছলে দেশের জাতীয় সম্মান অবৈধভাবে দেদার ব্যবহার করল সংস্থাটি।
আবার, দক্ষিণবঙ্গ কিক -বক্সিং এর দুদিনের এই আসরেই শুধু নয় ,জেলাস্তর থেকে রাজ্য, জাতীয়স্তরের এই ধরনের কিক -বক্সিং প্রতিযোগিতায় সমানতালেই চলছে দেশের জাতীয় প্রতীকের এহেন দেদার অসম্মান, যা নিয়ে আয়োজক সংস্থা তো বটেই, আশ্চর্যজনক ভাবে মুখে কুলুপ সরকারি আমলা,নেতা, মন্ত্রী, প্রশাসক, বক্সার থেকে পুলিশ কর্তাদের।
দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর রামমোহন এভিনিউয়ে গত শনি ও রবিবার (১১/০১/২৫—১২/০১/২৫) টানা চলল প্রথম দক্ষিণবঙ্গ কিক -বক্সিং প্রতিযোগিতা। তাতে অংশ নিলেন ১৪৭ জন প্রতিযোগী এবং আরো ৫০ জন অংশ নিলেন প্রতিযোগিতার বাইরে। প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল -পশ্চিম বর্ধমান জেলা স্পোর্টস কিক- বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন। যারা আবার নাকি জাতীয় স্তরে ‘ওয়াকো ইন্ডিয়া কিক- বক্সিং ফেডারেশন’ নামে হরিয়ানার ফরিদাবাদের একটি সংস্থা আর বিশ্ব কিক- বক্সিং ফেডারেশনের অনুমোদন প্রাপ্ত।
“ওরা বিশ্ব কেন, মহাবিশ্বের অনুমোদন নিয়ে আসুন না, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু, আমাদের দেশের গৌরবের প্রতীক নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ওদের কে দিয়েছে ?” – প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় কংগ্রেসের জেলা সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তী। তার আরও প্রশ্ন- “দেশের আর রাজ্যের শাসক দলের যা খুললামখুল্লা বেপরোয়া দশা – এরা আইনি বেআইনির আর কোনো ফারাকই রাখছেন না। বেআইনি কাজ করতে করতে এদের আর হুঁশজ্ঞানই যে থাকছে না, বক্সিংয়ের এই নির্লজ্জ ঘটনা তার প্রমাণ।”
এখন তাহলে প্রশ্ন হল – নিছক একটি বক্সিং প্রতিযোগিতার আড়ালে ঠিক কিভাবে জাতীয় সম্মানের লাঞ্ছনাটাই বা হল ? এই প্রতিযোগিতার ব্যানার, পোস্টারে বেআইনিভাবে দেদার ব্যবহার করা হয়েছে অশোক স্তম্ভ সম্বলিত দেশের জাতীয় প্রতীক। অথচ, এমন জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের কোন বৈধ অনুমোদনই দেয়নি কেন্দ্র সরকার, বা রাজ্য সরকার। এক বরিষ্ঠ প্রশাসনিক অধিকারীকের কথায়, “এভাবে মুড়ি-মুড়কির মতন কখনোই জাতীয় প্রতীকের ব্যবহার চলতে পারে না। এটা কেবলমাত্র সরকারি সংস্থা বা কোন সরকারি অনুষ্ঠানে ব্যবহার করার অনুমোদন আছে”।
দুর্গাপুরের কিক -বক্সিং প্রতিযোগিতার এই আয়োজক সংস্থাটি আদৌ সরকারী বা সরকার পোষিত নয়। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক খেলা সংস্থার অনুমোদন রয়েছে তাদের। সে কথা নিজের মুখেই কবুল করেছেন পশ্চিম বর্ধমান কিক- বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সর্বজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং আয়োজক কমিটির সভাপতি শান্তিময় কুন্ডু। হাতেনাতে বেআইনি কাজ ধরা পড়ার পর সর্বজিৎ এবং শান্তি নিজের মুখেই বললেন, “আমাদের অশোক স্তম্ভ ব্যবহারের কোন অনুমোদনই নেই। ভুলবশত আমরা এটি করে বসেছি। আমরা, আমাদের জাতীয় ও রাজ্যস্তরে যে সকল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সেখান থেকেই ব্যানার ও পোস্টারের অনুকরণ করার ফলেই এই ঘটনা ঘটেছে। অশোক স্তম্ভ ব্যবহার সম্বন্ধে আমরা অবগত ছিলাম না, তাই এই ঘটনা।” তাহলে এভাবে জাতীয় প্রতীক ব্যবহার কেন করেছেন, জানতে চাইলে তারা বলেন, “মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এই ঘটনার কথা আমাদের নজরে আসতেই আমরা সেই সমস্ত বিতর্কিত ব্যানার-পোস্টার নষ্ট করে সরিয়ে বাতিল করে দিয়েছি । আমাদের দুদিন চলা এই প্রতিযোগিতার মূল মঞ্চ ও তার আশেপাশে কোথাও এ ধরনের বিতর্কিত পোস্টার লাগানো ছিল না।” নিজের শারীরিক অসুস্থতার দরুন মন্ত্রী নিজে ওই বিতর্কিত প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি হয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি। মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার সোমবার বললেন, “আমি ওদের অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি ঠিকই, তবে ওরা ওদের প্রতিযোগীদের দেওয়ার জন্য সার্টিফিকেট গুলো সব সই করিয়ে নিয়ে গেছে।” রাজ্য সরকারের একজন বর্ষিয়ান দায়িত্ববান মন্ত্রীকেও এই সরকার অননুমোদিত প্রতীক ব্যবহারের অনুষ্ঠানের শরিক করে নিয়েছে তাদের ‘মস্ত ভুলে’র ছলে।
- ১৯৫০ সালের ‘জাতীয় প্রতীক ও নামের অপব্যবহার নিবন্ধক আইন’ মোতাবেক জাতীয় প্রতীক, সরকারি শীলমোহর, লোগোর বিনা অনুমোদনে ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- ভারতের জাতীয় প্রতীক নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আইন ২০০৭ মোতাবেক – অশোক স্তম্ভের ব্যবহার করার অনুমোদন নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে।
- ২০০৫ এর ‘জাতীয় প্রতীক অপব্যবহার নিবন্ধক আইন’ অনুযায়ী – জাতীয় প্রতীকের অপব্যবহার, নকল করা বা সরকারি সংস্থার মতো হাবভাব তৈরি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে শহরজুড়ে বিতর্কের দানা বাঁধতেই একে একে লেজ গুটিয়ে মুখলুকাতে শুরু করেছেন ওই কিক -বক্সিং প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থার হোমড়াচোমড়া কর্তা -ব্যক্তিরা। রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী গোটা বিষয়টিতে বেজায় বিরক্ত হয়ে বলেন, “ওরা এত বড় অন্যায় কাজ করল। সাথে আমাদের মান সম্মানটাও নষ্ট করল। আমি সই করা সব সার্টিফিকেট ফেরত চাইবো। পুলিশে অভিযোগ জানাবো”। তবে এটাও ঠিক যে এই সংস্থা যে সব সার্টিফিকেটগুলি মন্ত্রীকে দিয়ে সই করিয়েছিলেন সেগুলিতে ব্যবহার করা হয়নি অশোক স্তম্ভের প্রতীক।
মজার বিষয় হল- বিতর্কিত ওই প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে শহরের প্রধান পুলিশকর্তার উপস্থিতি সকলকে অবাক করেছে। প্রশ্ন উঠেছে – তিনি কি করে মঞ্চে বসে বসে জাতীয় প্রতীকের এই অপমান হতে দিলেন? তার নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে কেন তিনি খোঁজখবর না নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন ? এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশকর্তা অভিষেক গুপ্তা, যিনি আবার দুর্গাপুর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বললেন, “এ নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে থানায় অভিযোগ করতে পারেন।” তিনি ছাড়াও মঞ্চে ছিলেন দেশের সীমান্ত রক্ষীর বাহিনী বাহিনীর ডিআইজি অনিল সিং। ছিলেন জাতীয় শিক্ষকের সম্মানপ্রাপ্ত ডক্টর কলিমুল হক, বিশিষ্ট তৃণমূল নেতা উত্তম মুখার্জী, দুর্গাপুর শহরের মহানাগরিক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। এদিন অনিন্দিতা বলেন ,”আমি জানতামই না ওরা অশোক স্তম্ভ ব্যবহার করছে। ছিঃ ছিঃ, মহা অন্যায় করেছে ওরা”।
এ বিষয়ে পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিশিষ্ট তৃণমূল নেতা উত্তম মুখার্জী জানান, “আমি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম ঠিক। কিন্তু আমার নজরে জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করার কোন ছবি ধরা পড়েনি। যদি উদ্যোক্তারা জাতীয় প্রতীক অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আগামী দিনে কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে এসব বিষয়গুলো আমি নিশ্চয়ই খেয়াল রাখব।”
দুর্গাপুরের মহকুমা শাসক ডাক্তার সৌরভ চট্টোপাধ্যায় অবৈধভাবে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ ব্যবহার করার বিষয়টি কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং প্রশাসনিক স্তরে তদন্ত করে আইন মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
এত কিছুর পর, এই খেলার আয়োজক সংস্থার চেয়ারম্যান স্বর্ণপদক প্রাপ্ত খেলোয়াড় ফিরোজ খান সোমবার জানিয়েছেন, “আমাদের এই অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল ব্যানার ও পোস্টার করা হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটিতে ভুলবশত অশোক স্তম্ভের প্রতীক দেওয়া হয়েছিল এবং দুর্গাপুরের একটি সামাজিক মাধ্যমে তা ভুলবশত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনার কথা আমাদের নজরে আসতেই আমরা সমস্ত রকম বিতর্কিত পোস্টার সরিয়ে দিয়েছি। দুর্গাপুরের সামাজিক মাধ্যমে যে সকল ব্যানার ও পোস্টারের ছবি ছিল সেগুলিও সরিয়ে ফেলার জন্য সেই সব সামাজিক মাধ্যমের কর্ণধারকে জানানো হয়েছে। সম্ভবত এখন অব্দি তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মস্ত বড় ভুল কাজ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। আমরা খেলোয়াড়। এতসব বুঝিনি। জাতীয়স্তরে এমনই প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তাই না জেনে আমরাও করেছি।” এই ফিরোজ নিজেও কিন্তু ১৭ বারের রাজ্য কিক-বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এবং চার বারের স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত জয়ী খেলোয়াড়।