মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: বণিকসভার নামে দুর্গাপুর উৎসবের আড়ালে আসলে হিন্দুত্বের গোপন এজেন্ডা চাষ করছেন শাসকের পেয়ারের দু চার পিস্ বেওসায়ী, আর সেই মুজরায় ঠুমকা দিচ্ছেন শাসকের কোনো কোনো মন্ত্রী ? তারাও কি তবে কৌশলে মেলা খেলা প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীকে বোকা বানানোর এই চতুর খেলায় সমান অংশীদার, নাকি তারা স্রেফ রাজনৈতিক মেরুকরণের এই নয়া পরিস্থিতির অসহায় শিকার ?
অবিশ্বাস্য মনে হলেও দুর্গাপুর উৎসবের সময় এবং সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনা পরম্পরায় যে সব তথ্য উঠে এসেছে, এবং হাই ভোল্টেজ এই মেলার অবুঝ আয়োজকদের হাত ফস্কে যে প্রামাণ্য নথি উঠে এসেছে, তার বিশ্লেষণ করলে আসল সত্যি কিন্তু এরকমটাই দাঁড়ায়।
দুর্গাপুর উৎসবের উদ্বোধনের দিন আয়োজক বণিক সভার সভাপতির করা একটি ফেসবুক পোস্ট আসলে আয়োজকদের গোপন এজেন্ডাটিকে জনসমক্ষে উলঙ্গ করে দিয়েছে। দুর্গাপুর উৎসবের উদ্বোধনের সময় তিনি আরএসএসের ভাষায় দিনটিকে ‘শৌর্য দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান করে শিল্প সংস্কৃতির এই শহরে স্পষ্ট বিভাজনের রেখা টেনে ‘হিন্দুর স্বাভিমান ‘ জাগরণের উৎসাহ দিয়েছেন, যা নিয়ে দারুন চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে শহরের সংস্কৃতি মহলে। প্রশ্ন উঠেছে – ‘তবে কি আসলে গোপন এই এজেন্ডার লক্ষ্য পূরণেই কৌশলে দুর্গাপুর উৎসবের উদ্বোধন বেছে বেছে এবার ৬ই ডিসেম্বরে করা হলো ? রাম পুনিয়ানীর মতো ঐতিহাসিক যে দিনটিকে দেশের ইতিহাসের ‘কালো দিবস ‘ বলে চিহ্নিত করেছেন! গতবারের ১৬ দিনের উৎসব কিন্ত শুরু হয়েছিল ৩ ডিসেম্বরে।
বত্রিশ বছর আগে, ১৯৯২’ র ৬ই ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল আরএসএস, বজরংদল, শিবসেনার মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। সেই কলঙ্ক চাপা দিয়ে গৌরবের ইতিহাস রচনার বাসনায় উগ্র সংগঠনগুলি ৬ই ডিসেম্বরকে ‘শৌর্য দিবস’ বলে তাদের মতো করে পালন করে আসছে। এবারে, শিল্প শহরে সেই উদযাপনের জন্য সুচতুর ভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পত্তন হওয়া দুর্গাপুর উৎসবের মতো শহরের বৃহৎ ক্যানভাসকে, যার পোশাকি আয়োজক দুর্গাপুর বণিকসভা। সেই দুর্গাপুর বনিকসভার সভাপতির (চন্দন দত্ত) সমাজমাধ্যমে করা আবেগঘণ পোষ্টটিই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এবিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে, বনিকসভার সেই সভাপতি চন্দন দত্ত ভোল পাল্টে প্রলাপ বকে নিজের দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। তিনি রবিবার সকালে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কায়দায় বলেন, “ওই পোষ্টটা আমি তৈরি করিনি। আমি কিছু না বুঝেই ফরোয়ার্ড করেছি।” ভাবা যায় ? একজন অন্ততঃ ৪০০ কোটি টাকার ব্যাবসায়ী না বুঝেই, শাসক তৃণমুল কংগ্রেসের মন্ত্রী, নেতাদের ব্যবহার করে এমন একটি স্পর্শকাতর পোস্ট বাজারে ছেড়ে দিলেন ?
“না। এটাকে এত্তো সহজে হজম করে নেওয়া যায়না। এটা একটা পরিকল্পিত ছক যার নেপথ্যে আয়োজক কমিটির অনেকেই আছে। এরা তৃণমূলকে কি গরু গাধা ভেবে যা ইচ্ছে তাই করেই যাবে ?” – প্রশ্ন তৃণমুল কংগ্রেসের ব্লক কমিটির বেনাচিতি এলাকার এক বাসিন্দার। তিনি বলেন, “একজন রাজ্যের পাকা মাথার এক মন্ত্রী ওদের মোড়ল সেজে বসে আছেন আর একজন সরকারেরই একটি সংস্থার মাথায় নিজের আখের গোছাতে হঠাৎ এসে বসে পড়েছেন। তারাও কি এতটাই অবুঝ, নাকি তৃণমূলকে হেয় করার এই চক্রান্তে তারাও সমান অংশীদার, এটা বুঝে নেওয়ার এবার সময় এসেছে। জেলা নেতৃত্বই বা কি করছে ?” তিনি দাবি করেন, এইসব চন্দন দত্তরা সবই এখনো সিপিএম নেতা ভজন চক্রবর্তীর ভজনা করেন এখনো, আর তলে তলে বিজেপির নেতাদের পদ সেবায় ব্যস্ত। এদেরই জামাই আদরে এখন পুষে রাখছেন তৃণমুলের প্রদীপ মজুমদারের মতো লোকজন।
এই আয়োজক কমিটির অনেক মান্যবরই ২০২১ র বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন সকাল থেকে দুর্গাপুর (পূর্ব) কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী কর্নেল দীপ্তাংশু চৌধুরীর ঘরের মজলিশে বসে মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে বাছাই করা যে সব অশালীন ভাষায় খিস্তিখেউড় করেছিলেন, খোদ দীপতাংশু নিজে তাতে বিরক্ত হয়ে তাদের নিরস্ত করেছিলেন, এমন প্রমাণ মিলেছে অতীতে। মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার এখন তাদের চারপাশেই ঘুরঘুর করছেন আর এইসব দুর্গাপুর উৎসবের মহাগুরু সেজে মেতে আছেন। কিসের নেশায়, সময় বলবে।
রবিবারই মেলায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিবাদ মিছিলের ভয়ে ঢাকাই জামদানি শাড়ি বিক্রির একটি স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঐ স্টলের মালিক নদিয়ার শেখ শামসুর আহমেদ তার বিক্রি বাড়ানোর লোভে ভুল সময়ে বাংলাদেশের বিতর্কিত জাতীয় পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছিল, ক্রেতাদের কাছে জামদানি শাড়ির বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে।
উৎসব আয়োজক সংগঠনের সভাপতির পোস্ট এবং দুর্গাপুর উৎসবের সূচনার তারিখকে ঘিরে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন কংগ্রেসের জেলা সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তী। তিনি এদিন বলেন, “হয় বয়সজনিত কারণে প্রদীপবাবুর বিচক্ষণতা লোপ পেয়েছে, নয় জেনে বুঝে তিনি এমন সব লোকেদের কোলে তুলে নিচ্ছেন যারা তার সরকারকে কাদায় ফেলে মজালুটতে উদগ্রীব। আমরা শুধু নয়, ওদের এসব কাজ কারবার দেখে সবাই হাসছে। সবাই জানে এটা টিএমসি র মেলা। সেখানেই এমন সরষের ভেতরে ভূত ঢুকলো কার প্রশ্রয়ে, ওরা দেখুক।” সিপিএমের নেতা সৌরভ দত্ত বলেন, ” টিএমসি, বিজেপি এপিঠ আর ওপিঠ। এ আর নতুন কথা কি ? ওরা তো এসবই করবে আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় বসে সম্প্রীতির বড় বড় বুলি আওড়াবে!”