মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- দামোদর ও অজয় নদ এখন বালি মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। গ্রীন ট্রাইবুনালের নির্দেশিকাই সার। একদিকে বাঁকুড়ার সোনামুখী ও বড়জোড়া দুই থানার ওপর দামোদরে অবাধে চলছে অবৈধ বালি উত্তোলন। নদী গর্ভে ৭০ ফুট গর্তে পাম্প বসিয়ে ছাঁকনি মেশিন দিয়ে চলছে বালি উত্তোলনের কাজ। তারপর ওই বালি লরি ডাম্পারে ভর্তি হয়ে পাচার হচ্ছে। আর তার জেরে বিপন্ন হচ্ছে নদী তীরবর্তি মানাচরের জনজীবন। অবৈধ বালি বোঝাই গাড়ি যাতায়াতে ভেঙে পড়ছে গ্রামের রাস্তা। অতিষ্ট সাধারণ পথচলতি মানুষ থেকে কচি কাঁচা স্কুল পড়ুয়ারা । পাশাপাশি সেচের জলের টান পড়ছে কৃষি জমিতে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে হাইকের্টের দ্বারস্থ হন কৃষকরা।
অন্যদিকে নিম্ন দামোদরের পলাশডাঙা ও গোপালপুর মৌজা, অজয় নদের ওপর কাঁকসার বসুধা, সাতকাহানিয়া, পিয়ারাবাগান, শিবপুর, কাজলাডিহি, শ্যাওড়াতলা, কোটালপুকুর, থেকে রমরমিয়ে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন বলে অভিযোগ। একই রকম ভাবে দামোদরের সিলামপুর, বুদবুদের রনডিহা ঘাটে দিবালোকে ট্রাক্টরে করে অবৈধ বালি পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ। আর ওই বালি বোঝাই লরি, ডাম্পার যাতায়াতে ভেঙে পড়ছে গ্রামের রাস্তা। শুধু তাই নয়, বিজেপির অভিযোগ এসব বালি মাফিয়ারা শাসকদলের ভোট নিয়ন্ত্রন করে। সম্প্রতি গলসীর বিধায়কের সঙ্গে এক বালি মাফিয়ার হাত মেলানোর ছবি ভাইরাল হতেই শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে।
কিছু দিন আগে বালি কারবারিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন চকবাজার মানাচরে কৃষক শ্যামল মণ্ডল। গত বৃহঃস্পতিবার ছিল তার শুনানি। হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে মামলাকরির আইনজীবী সাহেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরন্ময় ভট্টাচার্য মামলার রায় দিয়েছেন। নির্দেশনামা W.P.A.(P)-163/2024, তাতে আগামী ৮ সপ্তাহের মধ্যে বড়জোড়া এলাকায় দামোদরে অবৈধ বালি উত্তোলনে জেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বালির খাদে বেআইনি কিছু যদি পাওয়া যায়, সেটা দেখতে বলা হয়েছে। ওইসব ঘাট এলাকায় যাবতীয় যন্ত্রপাতি, মেশিন ও পরিবহন গাড়ি বাজেয়াপ্ত করতে বলা হয়েছে।”
সোমবার দুর্গাপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাস্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জনসভা ছিল। ওই সভা থেকে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা বিজেপি’র বর্ধমান -দুর্গাপুরের প্রার্থী দিলীপ ঘোষ বালি কারবারিদের চরম হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন,”কয়লাতে একটু টাইট হয়েছে। এবার বালিতে টাইট হবে। ইডি, সিবিআই বসে নেই। তারা সব খবর রাখে। লম্বা তালিকা আছে। সেজন্য দেরি হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন,”বিনা কারনে লোকের ভাত মারি না। যারা অবৈধ বালি চালাচ্ছেন। ভাইপোকে খুশী করার জন্য তৃণমূলকে টাকা পাঠাচ্ছেন। আর সাধারন মানুষকে চমকাচ্ছেন। গুন্ডা পাঠাচ্ছেন ভোট করার জন্য। সাবধান করে দিচ্ছি। দিলীপ ঘোষ দুদিনের জন্য আসেনি। আগামী পাঁচ বছর থাকব। সব হিসাব হবে। এখানকার যারা বালি, পাথরের টাকা তুলে তৃণমূলকে সাপ্লাই করছেন। আর মানুষকে চমকাচ্ছেন। এসব দাদাগিরি বন্ধ করুন। আমরা জানি কাকে কিভাবে সোজা করতে হয়।”
লোকসভা নির্বাচন দোরগোড়ায়। তার আগে গতবছরই হয়েছে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়য়েত নির্বাচন। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব বার বার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে বালি কারবারিদের বিরুদ্ধে। বিজেপির অভিযোগ, লাগামছাড়া সন্ত্রাস আর রিগিংয়ে মানুষ আতঙ্কে বুথ মুখো হতে পারেনি। সন্ত্রাস করে পঞ্চায়েত দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস বলে তাদের অভিযোগ । আবারও একটা নির্বাচন। তার আগে গোটা কাঁকসার জঙ্গলমহলের মলানদীঘি, বিদবিহার, বনকাটি, গোপালপুর, সিলামপুর ও নিম্ন দামোদরের পলাশডাঙা ও গোপালপুর মৌজা, বাঁকুড়ার সোনামুখী ও বড়জোড়া দুই থানার এলাকায় সন্ত্রাসের আবহ তৈরী হয়েছে। অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষ খুনে অভিযুক্তরা এলাকার ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছে। তারাই নাকি অবৈধভাবে গরু, কয়লা, বালি, মাটি পাচারের কিংপিন।
উল্লেখ্য, গত ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর কাঁকসার সরস্বতীগঞ্জে মিটিং সেরে ফেরার পথে দুস্কৃতীদের গুলিতে খুন হয় বিজেপি কর্মী সন্দীপ ঘোষ। ঘটনায় তৎকালীন বিদবিহার পঞ্চেয়েতের তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য শেখ সাইফুল, জাহারুল মিদ্য, সুকুমার সাহা, শেখ হিরন সহ ৯ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করে বিজেপি বলে জানা গেছে। ঘটনায় জাহারুল, সুকুমার সাহা, শেখ হিরন সহ তিন জনকে গ্রেফতার করে কাঁকসা থানার পুলিশ। তবে অধরা থেকে যায় শেখ সাইফুল বলে অভিযোগ।
স্বভাবতই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসভার মঞ্চ থেকে বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি ও সিবিআই, ইডির তালিকা উল্লেখ করা সাথে সাথে দামোদর ও অজয় নদীর উপর অবৈধভাবে বালি উত্তোলনকারী বালি মাফিয়াদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। একটি সূত্র মারফত জানা গেছে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হলেই কোমর বেঁধে নামছে ইডি ও সিবিআই পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া সহ বেশ কয়েকটি জেলার বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে। একটি অন্য সূত্র মারফত জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে কলকাতা উচ্চ আদালতে বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডির তদন্তের দাবি জানিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা করতে চলেছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মকর্তারা।