সঞ্জীব মল্লিক, বাঁকুড়া : বাঁকুড়া জেলা মানেই লাল কাঁকুড়ে মাটি, বাঁকুড়া জেলা মানেই গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর চ্যাটার্জী ,যদুনাথ ভট্টাচার্যের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মনি ঋশিদের জন্ম স্থান । আর সেই বাঁকুড়া জেলার ইতিহাসে ” সনাতন দাস বাউল ” এক অন্যতম নক্ষত্র । যিনি জেলার সোনামুখী থানার ধুলাই অঞ্চলের খয়েরবুনি গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন । সালটা ছিল বাংলা ১৩৩০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস । প্রত্যন্ত একটা গ্রামে বড়ো হয়ে ওঠা , বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে লাল কাঁকুড়ে মাটির রাস্তা । সেই মেঠো পথের ভাটিয়ালী সুর আর কণ্ঠে বাউল গান তাকে এনে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি । তার প্রতিভা তার সুর ভারতবর্ষের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারেও সমান ভাবে সমাদৃত হয়েছিল । তার গলায় বাউল শুনতে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন দেশ বিদেশের শ্রোতারা । বোলপুরের বিশ্বভারতীর সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল । একটা সময় ছিল শান্তিনিকেতনের মেলা মানেই সনাতন দাস বাউলের কণ্ঠে বাউল গান । তাকে ছাড়া শান্তিনিকেতনের মেলা ভাবাই যেত না । তিনি ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারীখে ভারতবর্ষের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ইংল্যাণ্ডে এক অনুষ্ঠানে বাউল গান করতে গিয়েছিলেন । তবে তিনি শুধুমাত্র ইংল্যাণ্ড নয় আমেরিকা, স্কটল্যাণ্ড, লণ্ডন, প্যারিসের মত বিদেশের মাটিতে ভারতের হয়ে ভারতবর্ষের বাউলকে এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরে ছিলেন । সেই সময়ে বাংলা, হিন্দি, ইংরাজী খবরের কাগজ খুললেই তার ছবি দেখা যেত । জ্যোতিবসুর আমলে তিনি লালন পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন । ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারী বুধবার তার হাতে ” সাহিত্য অ্যাকাদেমি” পুরুস্কার তুলে দেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এ কে দোযাই । এছাড়াও তিনি ” সঙ্গীত নাটক অ্যাকাদেমি ” , ” পল্লব পুরুস্কার ” এ সন্মানিত হয়েছিলেন । বর্তমানে সনাতন দাস বাউলের সুযোগ্য পুত্র বিশ্বনাথ দাস ঠাকুর তার সুরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন । তিনিও বিদেশের মাটিতে ভারতবর্ষের বাউলের সুরকে তুলে ধরেছেন । তিনিও বাবার মত দূরদর্শনে গান করেছেন । বিশ্বনাথ বাবুর একটাই আক্ষেপ তিনি যখন থাকবেন না তখন তার বাবার এই সুর হয়ত আর থাকবে না । বর্তমান যুগে সে সময়ের বাউলের ততটা কদর নেই । তাই কেউই সেই সুর সেই তালিম শিখতে চাননি । কেননা বর্তমান যুগের আধুনিক বাউল গান যে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে । আর এ যুগের বাউল বিশ্বনাথ বাবুর কাছে বড়ই কষ্টের । এখনও সনাতন দাস বাউলের স্ত্রী মীরাদাস ঠাকুর বেঁচে আছেন । স্বামীর কথা বলতে যেয়ে তার চোখে জল চলে আসে । তবে বর্তমান সরকার তাকে কোনরকম ভাতা বা আর্থিক ভাবে সাহায্য করে না । তবে তিনিও সরকারের কাছে আবেদন করেন স্বামীর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকার উদ্যোগ নিক । তবে তার একটাই আক্ষেপ বর্তমানে সংস্কারের অভাবে তার সেই পুরুস্কার, তার নিজের হাতে বাজানো একতারা ,লাঠি ,দেশ বিদেশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য বিশেষ যন্ত্র আজ হারিয়ে যেতে বসেছে । মুছে যেতে বসেছে বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস । আর তাই এগুলোর সংস্কার না করা হলে হয়ত একদিন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে । সরকার এখনও পর্যন্ত সনাতন দাস বাউলের সেই স্মৃতি সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেননি । তার দাবি সরকার যদি এদিকে একটু নজর দিয়ে তার বাবার স্মৃতি চিহ্ন টুকু বাঁচিয়ে রাখতে একটি অডিটোরিয়াম ঘড়ের ব্যবস্থা করেন তাহলে ভালো হয় । সবকিছু ত্যাগ করে তিনি ১৪২২ বঙ্গাব্দের ১৪ ই ফাল্গুন শনিবার ভোর বেলায় তিনি পরলোক গমন করেন । সনাতন দাস বাউল হয়ত আজ নেই , তবে রয়েছে তার সুর , রয়েছে তার সেই চালা ঘড় । বাঁকুড়া জেলার গর্বকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সকলকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে ।