মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: মানে এবার ‘যত ইচ্ছা ডাকাতি কর শুধু লুঠের দরুন স্রেফ একটা ফাইন দাও’ – ব্যস তাহলেই দূর্গাপুর নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসকের মতে ‘সব লুঠ রেগুলারাইজ হয়ে যাবে’! নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসক যখন এমন মত পোষণ করেন তখন তা শহরের যত বেআইনি নির্মাণ তার দরুণ জরিমানা গুনাগার দিলেই এখন থেকে সবাই রাজা দুর্গাপুরে?
“দুর্গাপুর নগর নিগম বলে কিছু আছে আদৌ? ওটাতো এখন পাঁচ জমিদারের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, যাদের উজির তিন অফিসার, তিন কেরানি আর তাদের ওপর মহাগুরু তো একজনই যিনি সর্বত্র অবাধে ছড়ি ঘোরান, নিজের পেয়াদাদের ধান্দাপানি বজায় রাখতে, দু’নম্বরী নির্মাণ রক্ষা করতে ধমকে চমকে রাখেন নেতা অফিসার প্রায় সবাইকেই। ওনার হোটেল, বাণিজ্যিক কেন্দ্রর স্বার্থ বাঁচাতে আদা জল খেয়ে আসরে নেমে যে যার মত নাচনকোদন না করলে তাদের সবার পয়েন্ট কাটা যাবে। গর্দান যাবে কারো কারো,” বলে হাঁফ ছাড়লেন সান্তনু মিশ্র। এই শান্তনুই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে এডিডি এর চেয়ারম্যান কবি দপ্তর হোটেলের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে মোকদ্দমা করেছেন। দুর্গাপুরের বামুনাড়ার বাসিন্দা শান্তনুর সাফ কথা, “সব জেনে বুঝেও দুর্গাপুর নগর নিগমের রাজা উজিরেরা নিজের নিজের টিকিট বাঁচাতে কবি দপ্তর বেআইনি কাজকে দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। রসেবসে থাকা অফিসার কেরানীরা বদলির ভয়ে সিটিএ যাচ্ছেন। তা ওনারা যা খুশি করুন আদালতে একেবারে সব হিসাবকিতাব খোলসা হয়ে যাবে এবার।” প্রায় একই দাবি সমাজকর্মী সুব্রত মল্লিকের। বিধান নগরের এই সুব্রত গত ছয় বছরে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের কাজের নানান গরমিল নিয়ে আদালত এবং আইনি পরিষেবা কেন্দ্রের কাছে গুচ্ছগুচ্ছ অভিযোগও দায়ের করেছেন, যার কয়েকটিতে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে এডিডিএকে। সুব্রতর কথায়, “কবি দত্তর বিতর্কিত ওই হোটেলটিতে আগাগোড়াই গরমিল রয়েছে। বিনা অনুমোদনের প্ল্যানে বেআইনি নির্মাণের পর গত ১৫ বছর ধরে এই রাজপাট উনি সমান্তরালে চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনো বামের সেবক, কখনো দিদিমনির ভাই তো কখনও আবার রামসেবক সেজে ওনার ওই হোটেলের জমিটি আসলে ঠিক ক’টি প্লট মিলে তা একাধিক সরকারি দপ্তরই এখনো ঠিকঠাক জানে না। আবার, ওই প্লট গুলির আসল মালিকই বা কারা কারা?” তিনি বললেন, “চালাকি করে পাশাপাশি চারটি প্লট নিজের বাবা সহ এক ডাক্তার পত্নী আর নিজের নামে হজম করে সবগুলি একসাথে জুড়ে দু-দুটো ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। আরো দুর্ভাগ্যের যে এডিডিএ বা দুর্গাপুর নগর নিগমের নিয়ম ভেঙ্গে সব প্লট গুলি একসাথে জুড়ে ওই নির্মাণের অনুমোদনই বা দেওয়া হল কি করে? তাহলে কেবল উনার জন্যই নিয়মটি কি আলাদা? অন্যেরাও এভাবে পাসাপাসি প্লট কিনে একসাথে জুড়ে নির্মাণের ছাড়পত্র পাবে তো?” প্লট জুড়তে চেয়ে অন্তত হাফ ডজন আবেদন কবির দপ্তরেই গত দু বছর ঠাণ্ডা ঘরে ঘুমাচ্ছে।”

গত ১৮ আগস্ট ২০২৩ এডিডিএর সরবরাহ করা সরকারি পরিসংখ্যান মোতাবেক – কবি দত্তর পরিবারকে সিটি সেন্টারের ভিডিও প্লাজার নামে সিটি রেসিডেন্সি ও একটি শপিং প্লাজার জন্য জমি বরাদ্দ করা হয় চারটি প্লটে।
যেগুলি যথাক্রমে রেজিস্ট্রেশনও হয় দুর্গাপুরের সাব রেজিস্টার অফিসে। লিজ ডিড (আই ৯৫৮, আই ১৯৫১, আই ২৯৫৬ এবং ৫৪২ এইসব জমি এডিডিএর তরফে ঐ একই পরিবারের কবি, তার বাবা মিহির দত্ত এবং জনৈক শিল্পী মজুমদার নামক এক মহিলাকে বরাদ্দ করা হয় ১৯৯৭, ২০০৩, ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে। এডিডিএর তরফে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় ওইসব জমিতে নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন করবে দুর্গাপুর নগর নিগম।



জমির বরাদ্দ ছিল এইরকম:
- মিহির রঞ্জন দত্ত (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কবিদত্তের বাবা): মোট ৭.০৯ কাঠা জমি (৭.৯ লক্ষ টাকা দাম), সি এস প্লট নম্বর ৮৪৩ পি ও ৮৪৪ পি, জে এল নম্বর ৭৪ খতিয়ান নম্বর ১১৪
- মিহির রঞ্জন দত্ত: মোট ২৬.৫৩ কাঠা জমি (দাম ২১.২২ লক্ষ টাকা যা ছিল কাটা পিছু ৮০ হাজার টাকা দরে), প্লট নাম্বার ৮৪২, ৮৪৩, ৮৪৭, খতিয়ান নম্বর – ১৮৮, ১১৪ ও ১২৬
- ডাক্তার পল্লব মজুমদারের স্ত্রী শিল্পী মজুমদার: মোট ১৮.০৫ কাঠা জমি (দাম ১০.৮৩ লক্ষ টাকা – কাঠা পিছু মাত্র ৬০ হাজার টাকা), খতিয়ান নম্বর ১৮৮, ১১৪, ও ১২৬
- কবি দত্ত: মোট ৮ কাঠা জমি (দাম চার লক্ষ টাকা – কাঠা পিছু মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা) প্লট নাম্বার – ৮৪১ ৮৪৬ ও ৮৪৭
- ধাপে ধাপে কবি দত্তর পরিবারকে সিটি সেন্টারের বসত ভিটার বাইরে দেদার বাণিজ্যিক জমির বরাদ্দ করে গেছে এডিডিএ। সেই বাণিজ্যিক জমির ওপর একের পর এক ইমারত নগর নিগমের বৈধ প্ল্যান ছাড়াই নির্মাণ করে গেছে কবি ও তার পরিবার সেই বাম আমল থেকে। সকলের চোখের সামনে কোন আস্পর্ধা বা দু:সাহস বা বিশেষ কোন জাদুমন্ত্রে কবি এই সব বেপরোয়া নির্মাণ অবাধে চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর – এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে ক্ষমতার শীর্ষে রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া কবি দত্ত গরম দেখিয়ে শুধু এটুকুই বললেন, “এসব ব্যাপারে আমি কোনই কথা বলবো না।” এডিডিএ’র চেয়ারম্যান এখন কবি। তারই ঐ সরকারি সংস্থার মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক রাজু মিশ্র সম্প্রতি দুর্গাপুর নগরনিগমকে চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত কবি দত্তের ঐ হোটেলটির নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য তালাশ খোঁজ করতে বলে। নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখার্জি বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে গোড়ায় মুখ খুলতে না চাইলেও পরে সংবাদমাধ্যমের কাছে খুশি মুখে সাফাই দিয়ে বললেন, “ঐ হোটেলের কোন বেনিয়ম আমরা এখনো পাইনি। যা মানে হচ্ছে সবই ঠিক আছে।” যদি সবই ঠিক থাকে তাহলে দু দফায় কবি দত্তের সংস্থাকে ৭৫ লক্ষ টাকা জরিমানা কেন করেছিল নগর নিগম? না অনিন্দিতা এ প্রসঙ্গে অবশ্য আর কথা বাড়াতে চাননি। (চলবে)………






