জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,কলকাতাঃ- একটা সময় গ্রাম বাংলার যেকোনো উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মেলা, নাগরদোলা এবং বিনোদনের অন্যতম উপকরণ ছিল গ্রামের অর্থাৎ অ্যামেচার দলের যাত্রা। এই যাত্রা নিয়ে প্রথম সমস্যা শুরু হয় চরিত্র নির্বাচন নিয়ে। এখানে প্রত্যেকেই নিজেকে অপরের থেকে বেশি দক্ষ অভিনেতা বলে মনে করে। সেই সমস্যা দূর করে শুরু হয় রিহার্সাল এবং সেখানেও কারও কারও অনুপস্থিতি নিয়ে দেখা দেয় আর এক অশান্তি। কিন্তু সব ভুলে নির্দিষ্ট দিন সকালে শুরু হয় প্রবল উৎসাহ। রীতিমতো সাজো সাজো রব। প্রায় প্রতিটি অ্যামেচার দলে এই সমস্যা থাকলেও পরের বছরের জন্য আবার নতুন করে ভাবনা শুরু হয়। পাড়ার কোনো জমিদার বাড়িতে যাত্রা ছিল আর এক আকর্ষণ। এই ভাবেই গত প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসছে।
আনন্দের উল্টো দিকে আছে অর্থনীতি। অ্যামেচার দলগুলোকে ‘ফিমেল’, যাত্রার উপযুক্ত ড্রেস, মেকআপ ম্যান, বাজনা, লাইট ইত্যাদি ভাড়া করতে হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ড্রেস কোম্পানি। মূলত তারাই সব প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে থাকে। এরপর আছে যাত্রার প্যাণ্ডেল ও মঞ্চ তৈরি। অর্থাৎ অ্যামেচার যাত্রার হাত ধরে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হয়। আবার বিভিন্ন সময়ে এই অ্যামেচার দলগুলো চিৎপুরের পেশাদার দলগুলোর জন্য শিল্পী সরবরাহ করে থাকে। এক কথায় অ্যামেচার দলগুলো যাত্রা শিল্পের ‘লাইফ লাইন’।
অথচ মূলত অর্থনৈতিক কারণে বাংলার এই প্রাচীন সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে। গ্রামের বিভিন্ন উৎসবে আজ আর সেভাবে যাত্রা হয়না। উৎসাহ হারাচ্ছেন গ্রামীণ শিল্পীরা। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ড্রেস কোম্পানি। এই প্রাচীন সংস্কৃতি যাতে চিরকালের জন্য বন্ধ না হয়ে যায় তার জন্য পেশাদার যাত্রা জগতের ‘লিভিং লিজেন্ড’ রুমা দাশগুপ্তার উৎসাহে ২০১৮ সালে গড়ে ওঠে ‘যাত্রায় লোকশিক্ষা হয়’। মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ অর্থাৎ অ্যামেচার যাত্রা শিল্পকে রক্ষা করা। পাশে পেয়ে যান অ্যামেচার যাত্রা জগতের সুপরিচিত মুখ আনন্দ ব্যানার্জ্জী, সোমনাথ প্রামানিক, সাগর মন্ডল, রজত পাল, পিন্টু পন্ডিত, উজ্জ্বল ভট্টাচার্য, প্রিয় নাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখদের।
‘যাত্রায় লোকশিক্ষা হয়’ সংস্থার উদ্যোগে ১১ ই সেপ্টেম্বর কলকাতার নলিনী গুহ সভা ঘরে অ্যামেচার যাত্রা জগতের উন্নয়নের স্বার্থে এবং যাত্রা শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে এই প্রথমবারের জন্য এক বিরাট মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। অ্যামেচার ও পেশাদার জগতের বিশিষ্ট শিল্পীদের উপস্থিতিতে সেটি হয়ে ওঠে সত্যিকারের চাঁদের হাট।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্থার প্রধান উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত যাত্রা শিল্পী রুমা দাশগুপ্তা সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পেশাদার যাত্রা জগতের কিংবদন্তি শিল্পী অনল চক্রবর্তী, কাকলি চৌধুরী, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ ঘটক প্রমুখ এবং অ্যামেচার যাত্রা জগতের বিশিষ্ট নাট্যকার তাপস কুমার, কানন কুমার মাইতি ও প্রবীণ অভিনেতা পুর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অ্যামেচার যাত্রা জগতে বিশেষ অবদানের জন্য সংস্হার পক্ষ থেকে শেষোক্ত তিন জনকে ‘যাত্রা গৌরব’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। সম্মান পেয়ে তিন জনই আপ্লুত হয়ে ওঠেন। আবেগে গলা কেঁপে ওঠে।
অনল বাবু বলেন – আমরা প্রায় প্রত্যেকে অ্যামেচার যাত্রা জগতের হাত ধরে এখানে পৌঁছেছি। সুতরাং পেশাদার যাত্রা জগতের স্বার্থে অ্যামেচার যাত্রা জগতকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। তিনি হাত জোর করে মা-বোনেদের কাছে অনুরোধ করেন – আপনারা নিশ্চয় সিরিয়াল দেখবেন। যেকোনো সিরিয়াল সাধারণত পরের দিন সম্প্রচারিত হয়। সেটা দেখার সুযোগ থাকছে। যাত্রার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়।সুতরাং আপনারা যাত্রা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাত্রা দেখতে আসুন।
রুমা দেবী বলেন – শিল্পীর মৃত্যু ঘটেনা। দরকার তাদের মঞ্চটা ফিরিয়ে দেওয়া। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের প্রত্যেককে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে আবার যাত্রা শিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। প্রতিটি বক্তার কণ্ঠে শোনা যায় একই সুর।
সংস্থার পক্ষ থেকে জানা যাচ্ছে আগামী দিনে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলার অ্যামেচার শিল্পীদের নিয়ে তারা এই ধরনের আলোচনা সভার আয়োজন করবে।