জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- দুর্নীতির খবর সামনে আনতেই নৃশংসভাবে খুন হলেন সাংবাদিক। নৃশংসতার মাত্রা দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠলেন পোস্টমর্টের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসককুল।
শাসকদলের বিরুদ্ধে খবর করার অপরাধে দেশদ্রোহীতার আইনে আটক সাংবাদিক। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিন পেলেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। রাজনৈতিক দলের দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দলের কর্মীর হাতে হেনস্থার শিকার হলেন সাংবাদিক। মারধরের পাশাপাশি তার মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়, ভেঙে দেওয়া হয় ক্যামেরা। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। শাসকদলের মদতপুষ্ট বালি, কয়লা বা মাটি মাফিয়াদের হুমকি তো আছেই। টেণ্ডার ছাড়া গাছ কেটে বিক্রি করে দেওয়াটা অপরাধ নয়। কিন্তু সেই খবর করতে যাওয়াটা তাদের কাছে অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে। মাঝে মাঝে পুলিশ প্রশাসনের হাতেও সাংবাদিকরা অকারণে নিগৃহীত হয়। এইধরণের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে। শহর এলাকার আশেপাশে ঘটনা ঘটলে তাও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। শহর থেকে দূরে হলেই সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। প্রতিবছর সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জড়িত থাকছে শাসক ও বিরোধী দলের মদতপুষ্ট একদল দুষ্কৃতি। তাইতো প্রতিবাদের পরিবর্তে তারা নীরবতাকে হিরন্ময় বলে মনে করে। এইদেশের কোনো রাজনৈতিক দল দাবি করতে পারবেনা সাংবাদিকরা তাদের রাজত্বে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে।
ওরা সাংবাদিক, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সৈনিক ও অতন্দ্র প্রহরী। বিরোধী দলগুলো যখন শাসকদলের বিভিন্ন কুকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পায় তখনই গর্জে ওঠে অকুতোভয় সাংবাদিকদের কলম। প্রশাসন যখন কোনো অন্যায় চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে সাংবাদিকুল। তাদের কলমেই ধরা পড়ে ভূমিকম্প, বন্যা, বা ঝড়ের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া মানুষের দুর্দশার কাহিনী। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ‘গ্রাউণ্ড জিরো’ থেকে পাঠানো যুদ্ধক্ষেত্রের টাটকা ছবি ড্রয়িং রুমে বসে টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে শিহরিত হয়ে উঠেছেন দর্শকরা। করোনার সময় সবাই যখন আতঙ্কে চারদেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ ছিল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখনও ওরা খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। সমস্ত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে ওরা সর্বদা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলে।
গণতন্ত্রের বাকি তিনটি স্তম্ভের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের জন্য সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে থাকে রাষ্ট্র। তাদের নির্দিষ্ট বেতন আছে, বছরে দু’বার করে ডিএ বাড়ে, পেনশন আছে, নিরাপত্তা রক্ষী আছে এবং আরও অনেক কিছু আছে। কিন্তু তাদের পারফরম্যান্স বিচার করা হয়না। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দলীয় কর্মী খুন হলেও সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের জন্য নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য নির্ভয়ে কাজ করার মত নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়না। তাদের আর্থিক নিরাপত্তাও নাই। কিন্তু আছে ছাঁটাইয়ের হুমকি।
এটা ঠিক সঙ্গে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। এমনকি তাদের জন্য নুন্যতম আর্থিক নিরাপত্তা সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা যেতেই পারে, কিন্তু করা হবেনা। কারণ কেউই সাংবাদিকদের অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে চায়না। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ইচ্ছে থাকলেও রাজনৈতিক নেতাদের অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে হয়।
একদিন সমাজে সাংবাদিকদের সম্মান ছিল। তাদের প্রশ্নের মুখে পড়ে নেতা, মন্ত্রী সহ সমাজের উঁচু তলার মানুষরা অসহায় বোধ করত। কিন্তু সেটা আজ ভূলুণ্ঠিত। এরজন্য একদল সাংবাদিক অবশ্যই দায়ী। খবরের নাম সমাজে ‘সেনসেশন’ সৃষ্টির তাগিদে তারা যেভাবে গুজব ছড়াতে শুরু করেছে বা মিথ্যা খবর প্রচার করছে তাতে সম্মানহানি তো হবেই। সবক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের দোষ দেওয়া যায়না। তারা তাদের নিয়োগ কর্তার নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য।
যাইহোক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই চতুর্থ স্তম্ভকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতেই হবে। সাংবাদিকরা যাতে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে তারজন্য উপযুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে। একটা স্তম্ভ দুর্বল হয়ে পড়লে সমগ্র গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সাংবাদিকদেরও সচেতন হতে হবে। মাথায় রাখতে হবে তারাই গণতন্ত্রের প্রকৃত চৌকিদার। তাদের কলম দিয়ে যেন কালি বের হয়, তেল নয়।