স্টাফ রিপোর্টার, দুর্গাপুর: বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ধুলিস্যাৎ হয়েছে সেই কবেই, এরই মাঝে ছ’ বছর ধরে ওই কাচ কারখানার জমিতে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস গড়ার চেষ্টায় ফল মেলেনি। তাই আরেকবার ওই উদ্যোগে কোমর বেঁধে ময়দানে নামলো এডিডিএ।
শহরে তিন জায়গায় এখন তিনটি বাসস্ট্যান্ড। স্মার্ট সিটির তালিকা থেকে আগেই ছিটকে পড়েছে দুর্গাপুর। ছ বছর আগে দুর্গাপুরের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং উদ্যোগী হয়েছিলেন শহরের ডিভিসি মোড় সংলগ্ন এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস গড়ে তোলার ব্যাপারে। জমি পরিদর্শনও হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর এগোয়নি সেই কাজ। অজ্ঞাত কারণে লাল ফিতের ফাঁসে আটকে পড়েছিল আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসের কাজ। সেদিনের মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বিষয়টির প্রস্তাবক হোটেল ব্যাবসায়ী কবি দত্ত ঘটনাচক্রে এখন আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)’র চেয়ারম্যান। তাই, দায়িত্ব নিয়েই তিনি পুরোনো ফাইল ঘেঁটে পড়ে থাকা কাচ কারখানার ৪০ একর জমিতে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস তৈরিতে লেগে পড়েছেন। এই নিয়ে এদিন তিনি রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের উপস্থিতিতে দুর্গাপুরের মহকুমা শাসকের দপ্তরে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক করেন। জরুরী বৈঠক কারণ ওই জমি ভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা সম্প্রতি দেখা যায়।
দক্ষিনবঙ্গের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্য শহর দুর্গাপুর। রয়েছে একাধিক সরকারি, বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একাধিক সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল সহ নানান রাষ্ট্রায়াত্ত কারখানা ও সরকারি সংস্থার আঞ্চলিক অফিস। কিন্তু, শহরের উন্নতমানের আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস না থাকায় ক্ষোভ ছিল শহরবাসীর। গত ২০১৮ সালের ৫ মার্চ দুর্গাপুরের সৃজনী প্রেক্ষাাগৃহে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে দুর্গাপুর চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে এই কবি দত্তই দাবী তুলেছিলেন একটি আধুনিক মানের বাস টার্মিনাসের। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, “শহরের মান উন্নয়ন হয়েছে। মডেল রেল স্টেশন হয়েছে। কিন্তু সেরকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত কোন বাস টার্মিনাস নেই। এরকম একটি বাস স্ট্যান্ড দরকার যেখান থেকে আন্তঃরাজ্য বাস সার্ভিস থাকবে।” তারপরই মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উদ্যোগী হন। এবং তাঁর নির্দেশ মতো বাস টার্মিনাসের জমি পরিদর্শন করেন দুর্গাপুর মহকুমা প্রশাসন, এডিডিএ, পরিবহন দফতর ও দুর্গাপুর নগর নিগম। শহরের ১৯ নং জাতীয় সড়ক লাগোয়া বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ভারত অপথালমিক গ্লাস (বিওজিএল)র জমি পরিদর্শনও করা হয়। প্রায় ৪০ একর ওই জমি এখন এডিডিএ র অধীনে। যদিও বাস টার্মিনাসের জন্য প্রয়োজন কেবল ৮ একর।
এডিডিএ’র অধীনে জমিটি যেহেতু জাতীয় সড়কের লাগোয়া এবং দুর্গাপুর রেল ষ্টেশনের বেশ কাছাকাছি, ফলে ওই জমিতে বাস টার্মিনাস হলে সাধারন মানুষের সুবিধা হবে। বলা হয় বাস টার্মিনাস সংলগ্ন মার্কেট কমপ্লেক্সও তৈরী হবে ওই জমিতে। কিন্তু তারপর অজয়-দামোদর দিয়ে বয়ে গেছে বহুজল, কাজ এগোয়নি একচুলও।
মঙ্গলবার দুর্গাপুরের মহকুমা শাসকের কনফারেন্স রুমে এই বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকের মুল বিষয় ছিল আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসের প্রাথমিক কাজের গতি বাড়ানো। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দুর্গাপুরে অত্যাধুনিক মানের আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনালের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। এদিন বৈঠকে ছিলেন মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, এসবিএসটিসির চেয়ারম্যান সুভাষ মন্ডল, ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রণব ঘোষ, এডিডিএ এর চেয়ারম্যান কবি দত্ত, মহকুমাশাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, পুরসভার প্রশাসকমন্ডলীর চেয়ারপার্সেন অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় সহ পুলিশের আধিকারিকেরা।
মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেন, “কয়েক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাল গড়ার। কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। তবে নব নিযুক্ত এডিডিএ এর চেয়ারম্যান কবি দত্ত উদ্যোগী হন এই আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাল করার। এডিডিএ, পুরসভা, মহকুমা প্রশাসন, ট্রাফিক আধিকারিক এবং জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক হয়। আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাল কিভাবে তৈরি হবে, কত টাকার প্রয়োজন, সেই সব বিশদে জানতে একজন আর্কিটেক্টও নেওয়া হয় বৈঠকে। প্রতি সপ্তাহে কাজের অগ্রগতির জন্য রুটিন পর্যালোচনা করা হবে। নতুন আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসের জন্য কোন লাল ফিতের ফাঁস প্রতিবন্ধকতা হবে না।”
কিন্তু প্রস্তাবিত জমিতে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস তৈরীর বড় বাধা জবরদখল খাটাল। ওই প্রস্তাবিত এলাকায় প্রায় ২০০ পরিবারের জনবসতি রয়েছে। শহরের বুক চিরে যাওয়া জাতীয় সড়কের পাশে এই খাটালকে ঘিরে বহু প্রশ্ন উঠেছে। শহরের সৌন্দরজয়নে ওই ক্ষত ক্রমে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজেপি নেতা চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,”সামনে পুরভোট আসছে। তাই মনে পড়েছে শহরকে সাজানোর জন্য। ছ’ বছর ধরে কোন রূপরেখাই তৈরী হয়নি। সেখানে জবরদখল বড় বাধা। তৃণমূলের নেতারা টাকার বিনিময়ে সরকারি জমি দিয়ে জনবসতি গড়ে তুলেছে। ওইসব মানুষদের কি হবে, সেটা চিন্তা করুক। তাদের পুনরবাসন কি দেবে।” তিনি আরও বলেন,” গত একবছর ধরে দুর্গাপুরের উন্নয়নের জন্য কয়েক’শ কোটি টাকা এসেছে। হিসাব দেওয়ার ভয়ে খরচই করতে পারেনি এডিডিএ। তবে দুর্গাপুরকে সাজানোর জন্য রাজ্য যদি আর্থিক সহযোগিতা চায়, কেন্দ্র সরকার সেই আর্থিক সহযোগিতা করবে।”
অন্যদিকে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস তৈরীতে বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে এডিডিএ র চেয়ারম্যান কবি দত্ত বলেন,”ছ’ বছরে যেটুকু কাজ হয়েছে, আজকে সেটা বেসিক আলোচনা হয়েছে। আরও ছ’ বছর সময়দিন বিষয়টি সম্পন্ন করার জন্য। চেষ্টা করব দুবছরে শেষ করার। ডিপিআর তৈরী করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে কাজ হবে। জবরদখল জমি উচ্ছেদ নয়, আসলে আমাদের নিজেদের জমি প্রকল্পটির জন্য ফেরানো হবে।”