মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে বহুদিন ধরেই একটা অভিযোগ ছিল যে শিল্পাঞ্চলের দুই পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদর নদ ও অজয় নদ থেকে অবৈধভাবে দেদার বালি লুঠের কারবার চলছে। দুর্গাপুর, আসানসোল, জামুরিয়া, রানীগঞ্জ, পাণ্ডবেশ্বর, কাঁকসা এলাকায় এখনও চোরাগোপ্তা চলছে অবৈধ বালি উত্তোলনের ঢালাও কারবার, বলে অভিযোগ বিরোধীদের। এবার এই বিষয়ে নিয়েই নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বেশ কয়েকটি বিরোধীদলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাদের অভিযোগ – নির্বাচনের আগে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের একাংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে তৃণমূল কংগ্রেসের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা দামোদর ও অজয় নদ থেকে দেদার বালি লুঠ চালাচ্ছে। আবার এমন অভিযোগও উঠেছে যে, বিরোধী দলের কয়েকজন নেতা বালি মাফিয়াদের সাথে বখরার ভাগ নিয়ে। এর সাথেই পাল্লা দিয়ে চলছে কয়লার অবৈধ ডিও’র ফলাও কারবার। তাদের আরো অভিযোগ, এই সমস্ত অবৈধ কারবারের থেকে উপার্জিত অর্থ সরাসরি নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য খরচ করা হচ্ছে কৌশল করে। বিশেষতঃ শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। বিজেপির প্রার্থী দিলীপ ঘোষ অবশ্য হুমকি দিয়েছেন, বালি মাফিয়াদের জব্দ করার ব্যাপারে।
একটি বিশেষ সূত্র মারফত জানা গেছে, ইতিমধ্যেই দিল্লির নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করার একটি নির্দেশ নাকি দিয়েছেন। ঠিক তারপরেই, দুর্গাপুর আসানসোল শিল্পাঞ্চলের নির্বাচনের দায়িত্বে যে সকল পর্যবেক্ষকরা রয়েছেন, তারা গোপনে এই সমস্ত অবৈধ বালি ও কয়লা কারবারিদের বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে নাকি শুরুও করেছেন। বিশ্বস্ত একটি সূত্র মারফত এও জানা গেছে – জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যক্তি নাকি সরাসরি এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত। যদিও, এ বিষয়ে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দিন কয়েক আগে কাঁকসা এলাকার একটি বালিঘাট থেকে অবৈধভাবে বালির চোরা চালান করে পাচার করা হচ্ছিল শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের কিছু জনবসতিপূর্ণ এলাকার ভেতরে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ পেয়ে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারের অধীনস্থ নিউ টাউনশিপ পুলিশ স্টেশনের পুলিশ আধিকারিকরা ওই গাড়িটিকে আটক করেন। পুলিশের একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, কাঁকসার থানা এলাকার শিবপুর ঘাট থেকে অবৈধ বালি ট্র্যাক্টারে লোড করে আই কিউ সিটি রাস্তা ধরে ইস্পাত নগরী বিজনের ভারতী রোড হয়ে তা পাচার হচ্ছিল বিধান নগরের নির্মীয়মান আবাসন প্রকল্প গুলিতে। পুলিশ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে এই চোরাচালানের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে। নিউ টাউনশিপ পুলিশ স্টেশনের এক আধিকারিক জানান, “অবাক করার বিষয় হলো যখন বালির অবৈধ চোরা চালান বন্ধ করার নির্দেশ রয়েছে তখন কি করে পার্শ্ববর্তী থানা গুলির এলাকা অতিক্রম করে কিভাবে বিধান নগরে চলে আসছে এই অবৈধ বালির ট্রাক্টর। নাম প্রকাশে অনচ্ছুক এক পুলিশ কর্মী জানান, “অবৈধ বালি চোরা চালানোর সাথে যুক্ত কয়েকজন চিহ্নিত দুষ্কৃতী বেশ কয়েকজন পুলিশ আধিকারিককে মোটা টাকার প্রণামী দিয়ে এই ব্যবসা চালাচ্ছে শিল্পাঞ্চলে। কিন্তু, যখন যে এলাকাতে গাড়িটি ধরা পড়ছে সেই এলাকার পুলিশ আধিকারিক এর ওপর তখন তা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মীদের মনোবল তলানিতে ঠেকেছে।
এলাকার মানুষের অভিযোগ, “পঞ্চায়েত এলাকা হয়ে শহরে ঢুকছে একের পর এক ত্রিপল ঢাকা দেওয়া ওভারলোড বালি বোঝাই ডাম্পার। ছোট গাড়ি যাতায়াতের রাস্তায় এত বড় ডাম্পার যাতায়াতের ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার আতঙ্ক। দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের ধবনীর কুনুর ব্রিজ পেরিয়ে দুর্গাপুর নগর নিগমের বিজড়ায় পুলিশের নাকা পোস্ট হয়ে শোভাপুর তারপর দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর রাস্তা ধরে বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে বালি। অতি জনবহুল রাস্তা হয়ে ওভারলোড ডাম্পার যাতায়াতের ফলে দুর্ঘটনার আতঙ্কে ভুগছে এলাকার মানুষ। এইভাবে এই রাস্তা দিয়ে ‘দানবের মত’ বড় বড় ডাম্পার যাতায়াতের ফলে ছোট গাড়ি রাস্তায় যাতায়াত করতে পারছেন না। পাশেই রয়েছে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, রয়েছে বাজার ও হাসপাতাল। বহু স্কুল পড়ুয়া থেকে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে এই রাস্তায় একটি অবলম্বন। তাঁদেরও চরম সমস্যার মুখে পড়তে হয়।” দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক দাবি তুলেছেন তাঁরা।
একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, পাণ্ডবেশ্বর ও কাঁকসা থানা এলাকায় অবৈধ বালির চোরা চালানোর মূল পান্ডা জনৈক ‘মুনির’ নামক এক ব্যক্তি। এই ‘মুনির’ নাকি সমস্ত অবৈধ বালি ও কয়লার চোরা চালানের সাথে যুক্ত। মূলত তারই নির্দেশে নাকি পশ্চিম বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর ও কাঁকসা থানা এলাকা থেকে প্রতিদিন কয়েকশ ডাম্পার বালি অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা বহু অভিযোগ করা সত্ত্বেও এই ‘মুনির’ নামক বালি মাফিয়ার দাপটে ও প্রাণ সংশয়ের ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না বলে তাদের অভিযোগ। অন্যদিকে তাদের আরো অভিযোগ পুলিশকে এই বালি মাফিয়া ‘মুনির’ বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হলেও তার কোন ফল এখনো পর্যন্ত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জনজীবন।
একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, কাঁকসা ও পাণ্ডবেশ্বর থানা এলাকায় অবস্থিত দামোদর ও অজয় নদ থেকে এখনো প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাক অবৈধ বালি পাচার হচ্ছে শিল্পাঞ্চল থেকে আশেপাশের রাজ্য সহ কলকাতায়। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার বলে অভিযোগ। তাই বাধ্য হয়ে কি বিরোধী দলের অভিযোগ পেয়ে এবার আসরের নামতে চলেছে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক? সূত্র মারফত জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক অবৈধ বালি ও অবৈধ কয়লার ঘটনার তদন্ত শুরু করতেই বেশ কিছু নিচু তলার দুর্নীতিগ্রস্ত জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মীদের মধ্যে ভয়ে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু কোনভাবেই এখনো অবধি অবৈধ বালি ও কয়লা পাচার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করা যায়নি বলে অভিযোগ।